ধর্ম ডেস্ক
২৮ জুন ২০২২, ০২:২২ পিএম
পবিত্র কাবাঘরের দেয়ালে বিশেষভাবে স্থাপনকৃত পাথরের নাম ‘হাজরে আসওয়াদ’। এটি প্রাগৈতিহাসিক ইসলামি নিদর্শন এবং বেহেশতের বরকতময় পাথর। প্রথমে এর রং কালো ছিল না; রং সম্পূর্ণ সাদা ছিল। ক্রমান্বয়ে এর মাথার রংটুকু কালো হয়ে গেছে; তা-ও হঠাৎ করে নয়। বরং আস্তে আস্তে দীর্ঘদিন ধরে কালো হয়েছে।
রাসুল (স.) বলেছেন, ‘হাজরে আসওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর, তার রং দুধের চেয়ে বেশি সাদা ছিল। এরপর বনি আদমের পাপরাশি এটিকে কালো বানিয়ে দিয়েছে।’ (জামে তিরমিজি : ৮৭৭, মুসনাদে আহমদ: ১/৩০৭, ৩২৯)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘হাজরে আসওয়াদ জান্নাতেরই একটি অংশ’ (ইবনে খুজায়মা: ৪/২২০)। ‘হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়’ (নাসায়ি: ৫/২২১)।
আরবি ‘হাজর’ শব্দের অর্থ পাথর আর ‘আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ কালো। অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ অর্থ কালো পাথর। এটি বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথর। হাজিরা হজ করতে গিয়ে এতে সরাসরি বা ইশারার মাধ্যমে চুম্বন দিয়ে থাকেন। মর্যাদাপূর্ণ পাথরটি বর্তমানে পবিত্র কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দেয়ালে মাতাফ থেকে দেড় মিটার উঁচুতে গাঁথা অবস্থায় রক্ষিত আছে।
হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ শুরুর স্থানে অবস্থিত। প্রথমে এখান থেকেই তাওয়াফ শুরু করতে হয়। কাবাঘর তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা সুন্নত। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা সম্বন্ধে সর্বজনস্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমত হচ্ছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণকাজ শেষ করেন, তখন একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। অবশিষ্ট এ পাথরটি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথিরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে, কেবল আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম।’
আল্লাহ তাআলা তার ফরিয়াদের প্রতি-উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদনুযায়ী এ পাথরটিকে কাবাঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয় এবং তাওয়াফকারীকে এ পাথরে চুম্বন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনিভাবে কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল, কালো পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়।
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর নাজিল হওয়ার সময়ে হাজরে আসওয়াদও বেহেশত থেকে নাজিল হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)-কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তাআলা এ পাথরটিকে কাবা শরিফের স্থানে রেখে দিয়েছিলেন। তখন কাবাঘর ছিল না। জমিন ছিল পবিত্র, এতে কোনো গুনাহ সংঘটিত হতো না। হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় যখন সবকিছু ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) পাথরটি আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হলে তাওয়াফ শুরু করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল (আ.) একটি পাথর তালাশ করার সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা বায়তুল্লাহ শরিফের সবচেয়ে মর্যাদাবান জায়গায় তথা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করেন। তাই এ পাথরটি সাধারণ কোনো পাথর নয়। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তৈরি মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
রাসুলের (স.) নবুয়তপূর্ব সময়ে কাবা পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদ আগের স্থানে কে বসাবেন—এটি নিয়ে কোরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে গিয়েছিল। তখন মহানবী (স.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন। গোত্রপ্রধানরা চাদরটি ধরে কাবা চত্বর পর্যন্ত নিয়ে গেলে নবী করিম (স.) নিজ হাতে তা কাবার দেয়ালে স্থাপন করেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।
ইসলামপূর্ব কোরাইশদের যুগে কাবা শরিফের গিলাফ যখন পুড়ে গিয়েছিল, তখন হাজরে আসওয়াদও পুড়ে গিয়েছিল। ফলে তার কৃষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পায়। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)-এর শাসনামলে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি তা রুপা দিয়ে বাঁধাই করেছেন। আর তিনিই সর্বপ্রথম হাজরে আসওয়াদকে রুপা দিয়ে বাঁধানোর সৌভাগ্য অর্জনকারী। ১৭৯ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ হাজরে আসওয়াদকে হীরা দিয়ে ছিদ্র করে রুপা দিয়ে ঢালাই করেন। ৩১৭ হিজরিতে কারামতিয়ারা হারাম শরিফে অতর্কিত আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ৩৩২ হিজরিতে ফিরিয়ে এনে চুনা দিয়ে তার চারপাশ এঁটে দেওয়া হয়।
৪১৩ হিজরিতে এক নাস্তিক লৌহ শলাকা দিয়ে হাজরে আসওয়াদের ওপর হামলে পড়ে। ফলে তা ছিদ্র হয়ে যায়। এরপর বনি শায়বার কিছু লোক তার ভগ্নাংশগুলো একত্রিত করে কস্তুরী দ্বারা ধৌত করে তার টুকরোগুলো ফের জোড়া লাগিয়ে দেয়। ১৩৩১ হিজরিতে সুলতান মুহাম্মদ রাশাদ হাজরে আসওয়াদের চারপাশে রুপার একটি নতুন বেষ্টনী তৈরি করে দেন। ১৩৫১ হিজরির এপ্রিলের ১৮ তারিখে বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আলেম-ওলামাসহ কাবা শরিফে উপস্থিত হন এবং হাজরে আসওয়াদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তাতে মেশকে আম্বরের মতো মূল্যবান পাথর সংযুক্ত করেন। ১৪১৭ হিজরিতে পবিত্র কাবাঘরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদেও বিশেষ রুপার দ্বারা নতুন বেষ্টনী স্থাপিত হয়।
প্রতিবছর হজের মৌসুমে কিছু হাজি বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেন। অথচ এটির দরকার নেই। কেননা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন দেওয়া সম্ভব না হলে ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও চুম্বনের মতোই ফজিলত অর্জন হবে।
এমনটি মনে করা যাবে না যে, এই পাথর কারো ক্ষতি বা লাভ করতে পারে। বরং এই পাথর কল্যাণ-অকল্যাণ কিছুই করতে পারে না। কেননা ওমর (র) বলেছেন, إني أعلم أنك لا تضر ولا تنفع - ‘আমি নিশ্চয়ই জানি তুমি কল্যাণ অকল্যাণ কোনোটাই করতে পারো না’ (বুখারি: ৩/৪৬২)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (স.)-কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (মুসলিম: ১২৬৭)
সুতরাং, চুম্বন দেওয়া সম্ভব না হলে ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও হবে অথবা পাথরটির দিকে সম্প্রসারিত করে নিজ হাতে চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের অশেষ সওয়াব ও বরকত দান করবেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সকল হজযাত্রীদের নবী-রাসুলদের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ ও চুম্বন করার সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।