ধর্ম ডেস্ক
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫ পিএম
ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর সমগ্র জীবন ছিলো মানবিক পূর্ণতা, নৈতিক উৎকর্ষ ও ব্যবহারিক প্রজ্ঞার এক অসাধারণ সমন্বয়। তাঁর এই অতুলনীয় নেতৃত্ব মানবজাতির জন্য অনন্য অনুসরণীয় আদর্শ। পবিত্র কোরআনে তাঁকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ (বিশ্বজগতের জন্য রহমত) উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)
নবীজি (স.)-এর দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও সুশৃঙ্খল। তিনি তাৎক্ষণিক বিপ্লবের পথে না গিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনেন। প্রথম দিকে তিনি নীরবে নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেন, যেমন হজরত আলী, হজরত খাদিজা ও হজরত জায়েদ বিন হারিসা (রা.)। মক্কায় যখন নিপীড়ন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন, যা পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে ইসলাম প্রসারের পথ প্রশস্ত করে।
বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক কৌশলের ফল।’ (আল-সিয়াসাহ আল-শরিয়াহ, পৃষ্ঠা-৪৫)
আরও পড়ুন: মানবতার শিক্ষক বিশ্বনবী (স.)
মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ‘মদিনা সনদ’ ছিল ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সনদটিতে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষিত হয়। ইহুদি, মুশরিক ও মুসলিমদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মসজিদে নববী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক সংহতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন (রহ.) এর মতে, ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চিন্তা, ধৈর্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ভিত্তিতে।’ (আল-মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা-২৫৫)
নবীজি (স.) যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কেবল যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূরণেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং মানবিক ও কৌশলী দিকগুলো বিবেচনা করেছেন। বদরের যুদ্ধে বন্দীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে শিক্ষাদানের শর্ত দেন, যা প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বের এক দারুণ উদাহরণ। উহুদের যুদ্ধে উহুদ পাহাড়ে তীরন্দাজদের কৌশলগত মোতায়েন করেন। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের মতো প্রতিরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করেন, যা ছিল আরবে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা।
আরও পড়ুন: বিশ্বনবীর (স.) সামরিক কৌশল
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী বাহ্যিকভাবে মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর মনে হলেও, এটি ছিল নবীজি (স.)-এর দূরদর্শী নেতৃত্বের এক অমোঘ কৌশল। এই সন্ধিই পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের পথ প্রশস্ত করেছিল। ইমাম শাতিবি (রহ.) বলেছেন, ‘রাজনীতিতে সাময়িক ক্ষতিও দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের উৎস হতে পারে।’ (আল-মুওয়াকিফাত, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৭৫)
মক্কা বিজয়ের পর নবীজি (স.)-এর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ছিল ক্ষমার এক মহৎ দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর চরম শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের ওপর কোনো অভিযোগ নেই।’ এই ক্ষমাই হৃদয় জয়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল।
আরও পড়ুন: বদরের ৩১৩ সাহাবির নাম
রাসুল (স.)-এর জীবনাদর্শ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মুসলিম উম্মাহ যদি তাঁর প্রজ্ঞা ও কৌশলকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে।
মহানবী (স.)-এর জীবন আকাশের একটি নক্ষত্রপুঞ্জ, যা মানবজাতিকে আজও আলোকিত করে। তাঁর শিক্ষা ও কৌশল অনুসরণ করে মুসলিম উম্মাহ আবারও বিশ্ব সভ্যতার নেতৃত্ব দিতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে নবীজির জীবনাদর্শ বোঝার ও অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।