images

ইসলাম

কোরআন বুঝে না পড়ার ১০ ক্ষতি

ধর্ম ডেস্ক

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৫:২৫ পিএম

কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান, মানবজাতীর পথপ্রদর্শক। এটি এমন অমূল্য সম্পদ যে, পাঠ করলেও সওয়াব। ‘যে আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পড়বে, সে একটি নেকি পাবে। আর প্রতিটি নেকি দশগুণের সমান। আমি বলি না যে, ‘আলিফ লাম মিম’ একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মিম একটি হরফ’ (তিরমিজি: ২৯১০)।

আর কোরআনের ধারক-বাহক হতে পারলে সরাসরি আল্লাহর পরিবারভূক্ত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু পরিবারভুক্ত লোক আছে।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? তিনি বললেন, ‘যারা কোরআনের ধারক-বাহক; এরা আল্লাহর পরিবারভুক্ত ও তার বিশেষ লোক।’ (তারগিব ওয়া তারহিব: ০২/৩০৩)

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনার প্রতি এ বরকতপূর্ণ কিতাব নাজিল করেছি; তারা যেন এর আয়াতগুলো অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সুরা সোয়াদ: ২৯)। “তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তকরণ বন্ধ?” (সুরা মুহাম্মদ: ০৪)। অন্য আয়াতে এসেছে, “উপদেশ গ্রহণ করার জন্য আমি কোরআন সহজ করেছি; অতএব, কেউ কি আছে চিন্তা করবে?” (সুরা কামার: ১৭)

তবে, উপরোক্ত আয়াতসমূহের অর্থ এই নয় যে, কোরআন না বুঝে পড়লে সওয়াব হবে না। কেননা, কোরআন তেলাওয়াত একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। তবে, কোরআন সারাজীবন না বুঝে তেলাওয়াত করলে অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। নিচে তা বর্ণনা করা হলো—

১) ওহির উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ

কোরআন না বুঝে শুধু পড়তে থাকলে কোরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা করে। (সুরা ছোয়াদ: ২৯)

আর কোরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা না করলে এর আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা করা তো অসম্ভব একটি ব্যাপার।

২) মন হতে পারতো এক সজ্জিত উদ্যান

ফুলের বাগানে পরিচর্যা না হলে আগাছা জন্মায়। মনের আগাছা হচ্ছে শয়তানের ওয়াসওয়াসা, কুচিন্তাসমূহ। কোরআন তিলাওয়াত করার সময় মনে ভালো অনুভূতি জন্ম নেয়, যদি সেই আয়াতসমূহের প্রতি মনোযোগ না দেই এবং আল্লাহর আয়াত-নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করি, তাহলে তা হবে ফুল গাছ লাগানো বাগানে পানি না দেওয়ার মতো, সেখানে জন্মাবে আগাছা আর সেই উদ্যান হয়ে যাবে নষ্ট।

৩) তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত

কোরআন পাঠের পাঁচটি উদ্দেশ্য হতে পারে ১)আল্লাহর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ ২)ইলম অর্জন ৩)আল্লাহ যা করতে বলছেন তা বাস্তবায়ন করা ৪) মন ও অন্তরের আরোগ্যলাভ ৫)আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথোপকথন। অর্থ না বুঝার কারণে আমরা এ সকল উপকার লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

৪) ব্যধিগ্রস্ত অন্তর পরিশোধন হচ্ছে না

সবাই জানি ফজরের সালাত আদায় করা ফরজ। কিন্তু এরপরেও খুব অল্প কিছু মানুষ মসজিদের জামাতে অংশ নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু কেন? এমন নয় যে, তারা এ বিষয়টির গুরুত্ব জানে না, মূল কারণ হচ্ছে—আমাদের অন্তর ব্যধিগ্রস্ত ও মরিচা ধরা। অধিকাংশ লোকের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, কোরআন শুধুমাত্র একটি আদেশ-নিষেধের কিতাব। অথচ বিধি-নিষেধের আলোচনা করা হয়েছে এমন আয়াতের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগেরও কম ! বাকি ৯০ ভাগেরও বেশি আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে এমন বিষয় সম্পর্কে, যা আমাদের মন ও মস্তিষ্কের খোরাক, এগুলো আমাদের মনকে সতেজ ও পুষ্ট রাখে। কাজেই এই মরিচা পড়া অন্তরে ঘষা মাজা এবং মজবুত করতে চাই কোরআন। আমাদের চারপাশে নানা প্রলোভন ও পরীক্ষা থেকে বাঁচতে সর্বদা তাজকিরাহ ( এমন উপদেশ যা আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়) ও সতর্কবাণী মনে রাখা প্রয়োজন, যা আমরা লাভ করতে পারি অর্থ বোঝার মাধ্যমে। আল্লাহ এ কারণেই বলছেন—

“হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য”(ইউনুস ৫৭)  “আমি কোরআনে এমন বিষয় নাজিল করি, যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত...”। (ইসরা: ৮২)

অন্তরের ব্যধি থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর দেওয়া ওষুধের চেয়ে ভালো প্রতিষেধক আর কী হতে পারে? 

৫) মিলছে না দৃঢ়তা লাভের সুযোগ

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও সতর্কতার খবরে ঈমান বৃদ্ধি পায়। অন্তর দৃঢ়তা লাভ করে। আল্লাহ বলেন—

“আর যখন কোনো সুরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সুরা তোমাদের মধ্যেকার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলো? অতএব যারা ঈমানদার, এ সুরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে”। (তাওবা: ১২৪)

আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর অল্প অল্প করে কোরআন নাজিল করেছেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, কাফেরগণ জিজ্ঞেস করল, কোরআন তার (মুহাম্মদ স. এর) ওপর একসঙ্গে নাজিল হলো না কেন?

কাফেরদের এই প্রশ্নের উত্তরে একই আয়াতে আল্লাহতাআলা বলছেন, (আমি কোরআন অল্প অল্প করে নাজিল করেছি) যাতে করে আপনার হৃদয় শক্তিশালী হয়। (সুরা ফুরকান: ৩২)

সুতরাং হৃদয়কে শক্তিশালী করতে হলে নিয়মিত কোরআনের অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করার বিকল্প নেই।

৬) আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথোপকথন

হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) কোরআন তিলাওয়াতের সময় আয়াতসমূহের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতেন। যেমন- যখন তিনি আল্লাহতায়ালার প্রশংসা সম্বলিত কোনো আয়াত তিলাওয়াত করতেন, তখন তিনিও নিজে নিজে আল্লাহর প্রশংসা করতেন।

যখন কোনো প্রার্থনার আয়াত আসতো, তখন তিনিও প্রার্থনা করতেন, যখন কোনো আয়াতে আল্লাহতায়ালার আশ্রয় চাওয়া হতো, তখন তিনিও আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন। (মুসলিম)

কিন্তু কোরআনের অর্থ না বুঝলে আয়াতসমূহের সঙ্গে এরকম মিথস্ক্রিয়া করার কল্পনাও করা যায় না।

৭) নির্দেশনা বুঝে নেওয়া অসম্ভব

কোরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করা হয় কিংবা শোনা হয়, তার সবটাই আল্লাহর পক্ষ হতে মানবজাতির প্রতি সরাসরি নির্দেশনা। অর্থ বুঝে তিলাওয়াত না করলে আল্লাহতায়ালার এই নির্দেশনা অজানাই থেকে যায়, যা আল্লাহর একজন খাঁটি বান্দার জন্য বাঞ্ছনীয় নয়।

৮) আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বাধা

সালাত আদায় করা, রোজা পালন করা যদিও আল্লাহতাআলার ফরজ বিধান; কিন্তু শুধুমাত্র ফরজ বিধানসমূহ পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নয়।

বরং আল্লাহতাআলার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হলে হৃদয়ে তার জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে, তার প্রতিটি ফরজ বিধান পালনের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা থাকতে হবে, তার ওপর সীমাহীন আস্থা রাখতে হবে, তার সৃষ্টিসমূহ নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

আর কোরআনের অর্থসমূহ অনুধাবন না করলে ফরজ বিধানসমূহের পাশাপাশি হৃদয়কে পরিশোধিত করে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করা অসম্ভব।

৯) চরিত্র গঠনে কোরআন বোঝার বিকল্প নেই

হজরত আয়েশাকে (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চরিত্রের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, তার চরিত্র হল আল কোরআন।

সুতরাং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চরিত্র হলো আল কোরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাই নবীজীর সুমহান আদর্শ অনুসরণ করতে হলে সীরাত পাঠ এবং ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আয়াতসমূহের মিল খুঁজে বের করা জরুরি।  তাই কোরআন থেকে শিক্ষার বিকল্প নেই। কেননা তিনি নিজেই কোরআনের শিক্ষাকে অনুসরণ করে সুমহান চরিত্রের অধিকারী হয়েছেন।

আর তাই কোরআনি চরিত্র গঠন করতে হলে কোরআনের অর্থ অনুধাবনপূর্বক এর শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ (স.) একান্ত মনে ভাবনা-দুশ্চিন্তা ছাড়াই পাঠ করে যাচ্ছিলেন। 

আর বলো, ‘হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করাও উত্তমভাবে এবং বের করো উত্তমভাবে’। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাকে সাহায্যকারী শক্তি দান কর’। (ইসরা ৮০)

১০ কোরআনের চোখে বিশ্ব দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত

কোরআনহীন অন্তর শূণ্য ঘরের মতো, যে ঘরে কোনো আসবাব নেই। কোরআনের শিক্ষা না থাকার কারণে সে দুনিয়ার জগতকেই বড় ও আসল মনে করে। ফলে পরকালের প্রতি বান্দা হয়ে পড়ে উদাসীন। দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা বিচিত্র ঘটনার সামনে এসে দাঁড়াই। মুসলিম উম্মাহর উচিত—সমস্যাগুলোর সমাধান আল্লাহর কালামের কাছ থেকে নেওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করা। এটা কেবল তখনই সম্ভব হবে, যখন কোরআন বুঝতে পারবো, একইসঙ্গে দৈনন্দিন পরিস্থিতির মিল খুঁজে বের করতে পারবো।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের নিগূঢ় অর্থ বোঝার ও বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএ/