images

ইসলাম

স্বর্ণ আল্লাহর নেয়ামত নাকি পরীক্ষা

ধর্ম ডেস্ক

২০ জুলাই ২০২৫, ০১:৩২ পিএম

স্বর্ণের জৌলুস মানুষের হৃদয়কে সহজেই আকর্ষণ করে, কিন্তু এই আকর্ষণই হতে পারে আমাদের জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষা। ইসলামে স্বর্ণকে আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে এর সঠিক ব্যবহার ও প্রাপ্তির পদ্ধতি সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি

১. পরীক্ষার মাধ্যম: ‘মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চি‎‎হ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪)

২. জান্নাতের নেয়ামত: ‘জান্নাতিদের স্বর্ণ ও মুক্তার কঙ্কণে অলংকৃত করা হবে।’ (সুরা ফাতির: ৩৩)

হাদিসের শিক্ষা

১. সতর্কবার্তা: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘যারা সোনা-রুপা জমা করে আর আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, কেয়ামতের দিন তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে।’ (বুখারি: ১৪০৩)

২. ব্যবসায়িক বিধান: ‘সমান সমান ছাড়া সোনার বদলে সোনা বিক্রি করা নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, ‘সমান সমান ছাড়া তোমরা সোনার বদলে সোনা বিক্রয় করবে না। অনুরূপ রূপার বদলে রূপা সমান সমান ছাড়া (বিক্রি করবে না)। রূপার বদলে সোনা এবং সোনার বদলে রূপা যেভাবে ইচ্ছে, কেনাবেচা করতে পার। (বুখারি: ২১৭৫)

আরও পড়ুন: স্বর্ণের প্রতি অতি আকর্ষণ, কোরআনের সতর্কতা

বিশেষ বিধানাবলী

১. পুরুষের জন্য সোনার অলংকার ব্যবহার হারাম: ইসলামে পুরুষের জন্য স্বর্ণের গহনা পরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন রেশমি কাপড় এবং স্বর্ণ ব্যবহার না করে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২২৪৮) এমনকি তিনি এক সাহাবিকে সোনার আংটি পরতে দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার হাতে আগুনের অঙ্গার!’ (সুনানে নাসায়ি: ৫১৮৮, মুসনাদে আহমদ: ১১১০৯, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৪৮৯)। এই বিধান শুধু পরিধেয় গহনার জন্য প্রযোজ্য—চিকিৎসার প্রয়োজনে (অন্যকোনো উপায় না থাকলে) সোনার ব্যবহারে অনুমতি রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার: ৫/২৩৪)

২. নারীদের জন্য সোনার গহনা জায়েজ: নারীদের ক্ষেত্রে স্বর্ণ ও রূপার গহনা পরার অনুমতি আছে, তবে শর্ত হলো: ইসরাফ (অপচয়) না করা (সুরা আল-আরাফ: ৩১)। প্রদর্শনীমূলক ব্যবহার এড়ানো (সুরা নূর: ৩১)। অহংকার বা অলংকারের পূজা না করা (তিরমিজি: ২৩২২)।

৩. সোনার পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ: রাসুল (স.) স্বর্ণ-রূপার পাত্রে খাওয়া-দাওয়া ও পান করা নিষেধ করেছেন- ‘তোমরা স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্রে পান করবে না, এবং মোঢি রেশমি বস্ত্র ও মিহি রেশমি বস্ত্র পরিধান করবে না। কেননা দুনিয়ায় এসব কাফেরদের জন্য, আর তোমাদের জন্য হবে তা পরকালে—কেয়ামত দিবসে। (সহিহ মুসলিম, ইফা সংস্করণ, অধ্যায় ৩৮, পোশাক ও সাজসজ্জা: ৫২২০)

৪. সোনার ব্যবসার নিয়ম: স্বর্ণের লেনদেনে সুদের ঝুঁকি এড়াতে শরিয়তের শর্তাবলী মানতে হবে: নগদ লেনদেন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সোনার বদলে সোনা বিক্রি করলে সমান সমান ও নগদ হতে হবে।’ ভিন্ন বস্তুর বিনিময়ে: স্বর্ণের বদলে রূপা বা টাকা বিক্রি করলে পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে, তবে তাৎক্ষণিক বিনিময় জরুরি। (মুসলিম: ১৫৮৭)

৫. জাকাতের বিধান: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে এর ২.৫% জাকাত দেওয়া ফরজ (সুরা তাওবা: ১০৩)। ব্যবহার্য গহনা (যেমন: নারীর অলংকার) হানাফিমতে জাকাত ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৮৭)

আরও পড়ুন: কিছু স্বর্ণ কিছু রুপা থাকলে কোন হিসাবে জাকাত দেবেন?

৬. সোনার গহনা বিক্রি করে দান: অনাবশ্যক স্বর্ণ বিক্রি করে দান করা মোস্তাহাব। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সোনা-রূপার গহনা বিক্রি করে দরিদ্রদের দান করল, সে আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা।’ (তাবরানি: ১২/৪৫৬)

প্রয়োজনীয় সতর্কতা

  • সুদের ঝুঁকি: সোনার লেনদেনে সুদের সম্ভাবনা থাকায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
  • অহংকার: স্বর্ণের ব্যবহার যেন অহংকার ও প্রদর্শনীর কারণ না হয়।
  • জাকাত: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে জাকাত আদায় করা ফরজ।

শেষ কথা, স্বর্ণ আল্লাহর দান, কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘ধন-সম্পদ নিজেই কোনো দোষের নয়, বরং এর সঠিক ব্যবহারই প্রকৃত পরীক্ষা।’ (বুখারি: ৬৪৪২) আসুন আমরা এই নেয়ামতকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যবহার করি, ধ্বংসের উপকরণে পরিণত না করি।