ধর্ম ডেস্ক
১৮ জুলাই ২০২৫, ০৫:৩২ পিএম
ইমাম শুধু নামাজের নেতা নন, বরং তিনি সমাজের আধ্যাত্মিক কম্পাস, নৈতিক রক্ষাকবচ এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষক। বিশ্বব্যাপী ২৫ লাখ মসজিদে প্রতিদিন ইমামরা মুসলিম উম্মাহকে পথ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের তিন লাখ মসজিদের ইমাম শুধু নামাজের ইমামতি করছেন না, সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা আমার নির্দেশে মানুষকে পথপ্রদর্শন করত।’ (সুরা আম্বিয়া: ৭৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘ইমাম দায়িত্বে থাকেন এবং তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন।’ (সহিহ বুখারি ৮৯৩)
খুলাফায়ে রাশেদিন ছিলেন প্রথম ইমাম যারা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর মতো ইমামরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন।
ইমাম শুধু নামাজের ইমামতি করেন না, বরং তিনি সমাজের বহুমাত্রিক নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ভূমিকা শিক্ষা, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্তৃত।
আরও পড়ুন: মুয়াজ্জিন ও খাদেমের মর্যাদা
১. ধর্মীয় নেতৃত্ব: ইমামের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো ইবাদত-বন্দেগির নেতৃত্ব দেওয়া। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমা, ঈদ ও জানাজার নামাজ পরিচালনা করেন। এছাড়া, তিনি মুসল্লিদকে কোরআন-হাদিসের শিক্ষা দেন, ধর্মীয় মাসয়ালা-মাসায়েল বোঝান এবং ইসলামি জীবনব্যবস্থা অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে অনেক ইমাম স্থানীয় মক্তবে শিশুদের কোরআন শিক্ষা দেন, যা ইসলামি জ্ঞান চর্চার ভিত্তি তৈরি করে।
২. শিক্ষামূলক কার্যক্রম: ইমাম সমাজের প্রথম শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই দেন না, বরং নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের মতো গুণাবলীও শেখান। তুরস্কের অনেক মসজিদে ইমাম-হাতিব স্কুল চালু আছে, যেখানে শিশুরা ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা একসাথে পায়। বাংলাদেশেও অনেক ইমাম স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় সহায়তা করেন, বিশেষ করে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে।
৩. সামাজিক সংস্কার ও পরামর্শদাতা: ইমাম সমাজের বিবাদ মীমাংসাকারী এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। পারিবারিক কলহ, জমি-জমা নিয়ে বিরোধ, এমনকি বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের মতো সামাজিক সমস্যা সমাধানে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের অনেক ইমাম বাল্যবিবাহ রোধ, মাদকমুক্ত সমাজ গঠন এবং নারী শিক্ষা প্রচারে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। মালয়েশিয়ার মতো দেশে ইমামরা ফতোয়া কমিটির মাধ্যমে সামাজিক ইস্যুতে নির্দেশনা দেন।
৪. পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা: ইমামরা পরিবেশ রক্ষা এবং সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অনেক দেশে মসজিদকে কেন্দ্র করে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের ইমামরা মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন। এছাড়া, পানি সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধেও ইমামরা সচেতনতা তৈরি করেন।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ইমাম জাকাত, ফিতরা ও সদকা সংগ্রহ করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে সহায়তা করে। পাকিস্তানে কিছু মসজিদ মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম চালু করেছে, যেখানে ইমামরা ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশেও অনেক ইমাম স্বনির্ভরতা প্রকল্পে অংশ নিয়ে নারী ও যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে সাহায্য করেন।
৬. সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ: ইমামরা ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ জাগ্রত রাখেন। এছাড়া, স্থানীয় ভাষায় নসিহত করার মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় জ্ঞানকে সহজলভ্য করেন।
আরও পড়ুন: মসজিদে শুধু বসে থাকলে যে সওয়াব
কুমিল্লার ইমাম সাকের আলী ৩০টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন।
রংপুরের ইমাম ফরিদুল ইসলাম মাদকমুক্ত করতে ১০০ যুবককে পুনর্বাসিত করেছেন।
অর্থনৈতিক: ৬৫% ইমামের মাসিক আয় ১০,০০০ টাকার নিচে (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০২৩)
সামাজিক মর্যাদা: কিছু এলাকায় ইমামদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ তারাই যেকোনো বিষয়ে কোরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা দেয়ার যোগ্যতা রাখেন।
ঢাকার জামিয়া রহমানিয়ার ইমাম মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দ্বিগুণ সচেতন হয়ে কোরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হয়।’
সরকারি উদ্যোগ: ইমামদের বেতন ২০,০০০ টাকায় উন্নীতকরণ এবং বছরে ২ বার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
সমাজের ভূমিকা: মসজিদ কমিটি নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনা এবং ইমামদের সম্মানি বাড়ানো।
প্রযুক্তির ব্যবহার: ‘ডিজিটাল ইমাম’ প্ল্যাটফর্ম তৈরি (অনলাইন ফতোয়া সেবা)।
ইমাম হচ্ছেন সমাজের অদৃশ্য স্থপতি। তাঁদের মর্যাদা দেওয়া শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং একটি সুস্থ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। আসুন, আমরা ইমামদের যথার্থ সম্মান দিই—শুধু কথায় নয়, কর্মে।