ধর্ম ডেস্ক
০৬ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩৬ পিএম
কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মোড়। ৬১ হিজরির ১০ মহররমে ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর শাহাদাত কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের জন্য সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। এই প্রতিবেদনে আমরা প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলের আলোকে তাঁর আত্মত্যাগের গভীর উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করব।
ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সিংহাসন আরোহণ (৬০ হিজরি) ইসলামি খিলাফতের প্রকৃতিকে বিকৃত করেছিল। ইমাম হুসাইন (রা.) এই অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে যাত্রা করেন মূলত তিনটি কারণে-
ইয়াজিদের লোকেরা বলেছিল- ‘হুসাইনকে আমাদের আনুগত্য করতে হবে নতুবা আমরা তাকে হত্যা করব’ (তারিখ আল-তাবারি, খণ্ড ৪, পৃ. ৩০৪)। এটি ছিল ইয়াজিদের গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের নির্দেশে প্রেরিত চূড়ান্ত আল্টিমেটাম। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর এই আনুগত্য প্রত্যাখ্যানই পরবর্তীতে শাহাদাতের দিকে পরিচালিত করে।
আরও পড়ুন: আশুরার রোজা কোন দুই দিন রাখতে হবে?
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সতর্কতা: তিনি ইমাম হুসাইন (রা.)-কে বলেছিলেন- أُذَكِّرُكَ اللهَ فِي نَفْسِكَ، فَإِنَّكَ مِنَ الشُّهَدَاءِ ‘আমি তোমাকে আল্লাহর নামে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই তুমি শাহাদাতবরণ করবে’ (তারিখ দিমাশক, ইবনে আসাকির: ১৪/২০১)। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনে ছিল কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এবং ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর সংখ্যাধিক্য।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর পরামর্শ: তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন- لَا تَذْهَبْ إِلَى الْكُوفَةِ، فَإِنَّهُمْ قَتَلُوا أَبَاكَ، وَهُمْ أَخْوَةُ الْأَشْقِيَاءِ ‘কুফায় যেও না, তারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছিল এবং তারা দুর্ভাগ্যজনক ভাইদের মতো (বিশ্বাসঘাতক)’ (আল-ইসাবা ফি মাআরিফাতিস সাহাবা: ১/৩৩৩)। তাঁর এই পরামর্শের ভিত্তি ছিল কুফাবাসীদের অতীত বিশ্বাসঘাতকতা।
ইসলামের সত্যিকারের রূপ পুনরুদ্ধার: তিনি বলেছিলেন- ‘আমি শুধু আমার নানার উম্মাহর সংস্কারক হতে এসেছি।’ (আল-বিদায়া: ৮/১৬৩)
অন্যায়ের মুখে দৃঢ়তা প্রদর্শন: তাঁর শেষ বক্তব্য ছিল- ‘আল্লাহর কসম! আমি কখনই অপমানজনক আত্মসমর্পণ করব না।’ (তারিখ আল-ইসলাম: ৩/৩০৭)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: তিনি বলেছিলেন- ‘ধৈর্য ধরো হে প্রাণ! এ তো একটি দিনমাত্র।’ (আল-বিদায়া: ৮/১৮২)
আরও পড়ুন: নবীজির বাগানের দুই ফুল হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.)
শায়খ ড. মুহাম্মদ আল-গাজালি (রহ.) বলেন, ‘কারবালা ছিল ইসলামি ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। হুসাইন (রা.) শুধু ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি, তিনি সমগ্র উম্মাহর বিবেককে জাগ্রত করেছিলেন।’ (মিন হুনা নালাম: ২/১৫৬)
ড. আলী জুমআ এর মতে, ‘ইমাম হুসাইনের সংগ্রাম ছিল মূলত ইসলামের ‘আমর বিল মারুফ’ নীতির বাস্তবায়ন। আজকের প্রেক্ষাপটে এর অর্থ হলো- অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।’ (আল-বায়ান আল-মুআসির: পৃ. ৮৯)
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ আমাদের শেখায়-
নবীজি (স.) বলেছেন- ‘হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে।’ (সুনান তিরমিজি ৩৭৭৫)
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ ছিল ইসলামের সত্যিকারের চেতনা পুনরুদ্ধারের এক মহান সংগ্রাম। ড. ইসমাইল আল-ফারুকির ভাষায়- ‘কারবালা প্রতিটি মুসলিমকে প্রশ্ন করে: তুমি কি সত্যের জন্য হুসাইনের মতো দাঁড়াতে প্রস্তুত?’ (ইসলামিক কালচারাল অ্যাটলাস: পৃ. ২৯৮)