ধর্ম ডেস্ক
২২ জুন ২০২৫, ০৬:২৬ পিএম
ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি সম্মান, সেবা ও সদাচরণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিশেষত যখন তারা বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন সন্তানদের দায়িত্ব আরও বাড়ে। কোরআন ও হাদিসে এই বিষয়কে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, একে জান্নাতের পথে পরিণত করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানব—ইসলাম কীভাবে আমাদের শেখায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে সময়, সঙ্গ ও সেবা দেওয়ার সঠিক আদব।
কোরআনুল কারিম স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, পিতা-মাতার প্রতি সদয় ও ভদ্র আচরণ করতে হবে, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে যখন তাদের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা বেড়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন- وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَكَ الۡكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا كَرِیۡمًا ‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্যকারো ইবাদাত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন- ‘আমি তোমাদের সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহর কথা বলব? সাহাবাগণ বললেন- জি, বলুন। রাসুল (স.) বললেন, তা হলো- আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অথবা মিথ্যা কথ্যা বলা।’ (মুসলিম: ২৬৯)
আরও পড়ুন: মায়ের সেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি
অন্য হাদিসে নবীজি (স.) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের জন্য বদদোয়া করে বলেন, ‘তার নাক ধূলি ধূসরিত হোক। কথাটা তিনবার বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কার কথা বলছেন? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার কোনো একজনকে অথবা উভয়জনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমত করে জান্নাতের উপযুক্ততা লাভ করতে সক্ষম হলো না।’ (মুসলিম: ২৫৫১)
ধৈর্য ও সম্মান: বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের পরীক্ষা
বৃদ্ধ পিতামাতার সাথে বিনয়পূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও শ্রদ্ধাসূচক আচরণ করা জরুরি। বিশেষত তাদের মেজাজের পরিবর্তন বা অল্পে রাগ হলেও ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ বয়সের সঙ্গে মানসিক দুর্বলতা স্বাভাবিক। বস্তুত সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মা-বাবার তুলনা অন্যকারো সঙ্গে চলে না। আর এটাতেই জান্নাতের গ্যারান্টি। সেজন্যই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২১)
সময় ও সঙ্গ: নিঃসঙ্গতার প্রতিষেধক
সন্তানদের উচিত নিয়মিত তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, কথা বলা এবং সামাজিক ও মানসিক সহায়তা প্রদান। একাকীত্ব বৃদ্ধির ফলে মা-বাবা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনার ফজিলত অনেক বড়। সন্তান নিজের দুঃখে, সুখে সর্বাবস্থায় সবসময় বাবা-মার দিকে যদি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির নজরে তাকায়, তাহলে সন্তানের আমলনামায় কবুল হজের সওয়াব লিখে দেওয়া হয়। এমনকি সে সন্তান যদি পিতামাতার দিকে ১০০ বারও তাকায়, তার আমলনামায় ১০০ কবুল হজের সওয়াব দেওয়া হবে। (শুআবুল ঈমান: ৭৪৭২; মেশকাতুল মাসাবিহ: ৪৯৪৪)
আরও পড়ুন: মা-বাবার জন্য যে দোয়া করলে ১৯০ কোটি নেকি লাভ হবে
চিকিৎসা ও শারীরিক সেবায় দায়িত্বশীলতা
বৃদ্ধ মা-বাবার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য যত্ন নেওয়া এবং তাদের আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা ইসলামের নির্দেশ। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.) এর কাছে এসে বলল- আমি জিহাদে অংশ নিতে চাই, কিন্তু আমার সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা নেই। তখন রাসুল (স.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার মাতা-পিতার কেউ কি জীবিত আছেন?’ লোকটি বলল, আমার মা জীবিত। তখন রাসুল (স.) বললেন, ‘তাহলে মায়ের সেবা করে আল্লাহর নিকট যুদ্ধ-সংগ্রামে যেতে না পারার অপারগতা পেশ করো। এভাবে যদি করতে পার এবং তোমার মা সন্তুষ্ট থাকেন তবে তুমি হজ, ওমরা এবং জিহাদের সওয়াব পেয়ে যাবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং মায়ের সেবা করো।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১৩৩৯৯)
সমাজে উপেক্ষা ও আমাদের কর্তব্য
আধুনিক সমাজে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ায় বৃদ্ধ মা-বাবার একাকীত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্তানরা কর্মব্যস্ত ও বিদেশে থাকার কারণে সঙ্গ কম পাওয়া একটি গভীর সমস্যা। যদিও বাংলাদেশে ‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’ রয়েছে, তবুও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে আইন কার্যকর হচ্ছে না। আলেমরা বলেন, সমস্যার মূল হলো পারিবারিক ও দ্বীনীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া। হাদিসে ঘোষিত হয়েছে, ‘দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, পৃষ্ঠা: ৩৪)
দ্বীনী শিক্ষা: দয়ালু সন্তানের প্রস্তুতি
আলেমদের পরামর্শ হলো- শিশুকাল থেকেই সন্তানদের মাঝে দ্বীনীয় মূল্যবোধ, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। কারণ বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার মন-মেজাজ বোঝা এবং ধৈর্য সহকারে তাদের সেবা করার জন্য এটি অপরিহার্য।
দোয়া ও করুণা: সন্তানের হৃদয়ের ভাষা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দোয়া করতে বলেছেন- رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا ‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমাকে শিশুকালে লালন-পালন করেছে, তেমনি তাদের প্রতি করুণাময় হোন। (সুরা ইসরা: ২৪)
এটি সন্তানদের কাছে একটি স্মরণিকা, যাতে বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি দয়া, মমতা ও শ্রদ্ধা বজায় থাকে।
আরও পড়ুন: মা-বাবার জন্য আল্লাহর শেখানো ৩ দোয়া
মোটকথা, বৃদ্ধ মা-বাবাকে সময় দেওয়া ও সঙ্গ দেওয়া শুধু পারিবারিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি ইবাদত—আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। ইসলাম আমাদের শেখায়—ধৈর্য, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও সেবার ছায়াতলে কীভাবে জান্নাতের পথ নির্মাণ করা যায়। এ মূল্যবোধ যদি সমাজে ফিরে আসে, তবে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে এবং আমাদের মা-বাবারা শেষ বয়সে পাবেন ভালোবাসা ও সম্মানভরা জীবনের নিশ্চয়তা।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন— ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে পিতামাতার সন্তুষ্টিতে, আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে পিতামাতার অসন্তুষ্টিতে।’ (তিরমিজি: ১৮২১) এ হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—পিতামাতার খেদমত কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং তা একজন মুমিনের নিরঙ্কুশ ঈমানদারিত্বের নিদর্শন।