ধর্ম ডেস্ক
২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪২ পিএম
ইসলামে প্রতিবেশী শব্দটা খুবই স্পর্শকাতর। প্রতিবেশী মুসলিম হোক বা অমুসলিম, অযথা ঝগড়া-বিবাদ কিংবা যুদ্ধে জড়ানো নাজায়েজ। বরং আজীবন সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলাই ইসলামের নির্দেশ। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)
প্রতিবেশী ব্যক্তি বা দেশ, উভয়ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান একই। তাদের বিপদ-সংকটে পাশে থাকা ও যতটা সম্ভব সহযোগিতা করার শিক্ষা দেয় ইসলাম। সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর ওপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে (মুসলিম) তার জানাজায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না। কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না বরং তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও, যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে, অন্যথায় সে ফল তুমি গোপনে তোমার বাড়িতে নেবে। এমন যেন না হয়, তোমার ছেলে এ ফল নিয়ে বাইরে বের হলো আর তার ছেলে তা দেখে অস্থির হয়ে পড়ল।’ (ফাতহুল বারি খ. ১০, পৃ. ৫১৯)
প্রতিবেশীর হক নিয়ে খুব সচেতন থাকতেন সাহাবায়ে কেরাম। প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা, সমস্যায় পড়লে এগিয়ে যাওয়া, কোনোভাবেই কষ্ট না দেওয়া এবং উপহার-উপঢৌকন দেওয়া ছিল সাহাবিদের বিশেষ আমল। এক হাদিসে এসেছে, একদিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর ঘরে একটি বকরি জবাই করা হলো। খাবার রান্না হলে তিনি তার গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীর নিকট কি এ খাবারের কিছু হাদিয়া পাঠিয়েছো? এরপর তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরাইল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিল, আমি মনে করছিলাম- সে হয়ত তাদেরকে ওয়ারিশই বানিয়ে দেবে।’ (সুনানে তিরমিজি: ১৯৪৯)
আরও পড়ুন: জান্নাতে যেতে ন্যূনতম যেসব আমল করতে বলা হয়েছে হাদিসে
প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) সতর্ক করে বলেন— ‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষালম্বন করব।’ (মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার: ৫৭৫০)
অতএব, প্রতিবেশীর সঙ্গে ছোটখাটো কারণে বা বিনা কারণে যুদ্ধ করা যাবে না। এমনকি অবস্থা খারাপের দিকে গেলেও প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে না জড়িয়ে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। তবে, প্রতিবেশী যদি বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করে, এক কথায় যুদ্ধ ছাড়া কোনো উপায় না থাকে, কেবল তখন যুদ্ধ করা যাবে। আবার, কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধ আবশ্যকও হয়ে যায়, বিশেষ করে জুলুমের সীমা অতিক্রম করলে ওই জুলুম থামিয়ে দেওয়ার জন্য মুসলিম ইমামের অনুমতি সাপেক্ষে যুদ্ধ করতে হবে। সে অবস্থায় যুদ্ধ এড়িয়ে গেলে কঠিন গুনাহ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, যখন কাফেরদের চড়াও হয়ে আসা অবস্থায় তোমরা তাদের মুখোমুখি হও, তখন তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করো না। সেদিন যুদ্ধকৌশল অবলম্বন অথবা দলে স্থান লওয়া ব্যতীত কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্রোধ নিয়ে ফিরবে এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর তা অতি মন্দ ঠিকানা।’ (সুরা আনফাল: ১৫-১৬)
অতএব, যুদ্ধ ছাড়া কোনো পথ না থাকলে বা যুদ্ধ জরুরি হয়ে গেলে যুদ্ধের অনুমতি দেয় ইসলাম। তবে সেক্ষেত্রেও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। অমুসলিমদের বাড়িঘরে হামলা বা মন্দিরে আক্রমণ করা যাবে না। লাশকে ছিন্নভিন্ন করা যাবে না। শিশুরা যেন আক্রমণের শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: বেশি মানুষ বেহেশতে যাবে যে দুই কারণে
মহানবী (স.) যুদ্ধে সৈন্যদল পাঠানোর সময় বলতেন- ‘তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা করো। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি যে. (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না। (ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ: ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ)
যুদ্ধের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই তাদের হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এমনকি শত্রু বাহিনীর সেনাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও। হাদিসে এসেছে, নবীজি (স.)-এর যুগে কোনো এক যুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মহিলাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। নবীজি খুব বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করে ফরমান জারি করলেন। (বুখারি: ৩০১৫)
যুদ্ধজয়ের পর কারো ওপর জুলুম করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা মূলত ন্যায়নিষ্ঠ মুমিনদের ভালোবাসেন। ইরশাদ হয়েছে—‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহিনা: ৮)
মূলত ইসলাম শান্তি শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতির ধর্ম। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও অশান্তি সমর্থন করে না ইসলাম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (স.) ছিলেন এক অনন্য কালপুরুষ। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে নবীজির সুন্নত অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।