ধর্ম ডেস্ক
১৪ জুন ২০২২, ১২:৪৭ পিএম
ইসলামে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেসব আমলে একইসঙ্গে অপরিসীম সওয়াব লাভ হয় আবার তা মর্যাদা বৃদ্ধিরও কারণ। নিচে সেরকম কিছু আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১) বিনয়ী হওয়া
ব্যক্তিত্বের প্রথম সূত্র হচ্ছে বিনয়ী হওয়া। যার মধ্যে বিনয়-নম্রতা নেই, সে অহংকারীদের কাতারে চলে যায়। মহান আল্লাহ বিনয়ী মানুষের প্রশংসায় বলেন, “দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’...। ” (সুরা ফুরকান: ৬৩-৬৬)
সুফিয়ান সাওরি (রহ) তাঁর শিষ্যদের বলেন, ‘তোমরা কি জান নম্রতা কী? তারা বলল, আপনি বলুন, হে আবু মুহাম্মদ! তিনি বললেন, প্রত্যেক বিষয়কে যথাস্থানে রাখা। কঠোরতাকে কঠোরতার স্থানে, নম্রতাকে নম্রতার স্থানে, তরবারিকে তরবারির স্থানে, চাবুককে চাবুকের স্থানে।’ (ফায়জুল কাদির: ৪/৭৩ পৃ.)
২) আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা
ইসলামের পরিভাষায় যেকোনো প্রয়োজন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করাকে তাওয়াক্কুল বলে। হালাল জীবিকার জন্য চেষ্টা করে যাবেন, প্রয়োজনে কঠিন কাজ করবেন, কিন্তু ভরসা রাখবেন আল্লাহর ওপর। কারো কাছে হাত পাতবেন না, এতে আপনার ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু থাকবে না। হাত পাতবেন মহান আল্লাহর কাছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: ৩)
৩) সন্তুষ্ট থাকা
আল্লাহ তাআলা আপনাকে যেভাবে রেখেছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন। খুশি মনে থাকুন। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ মানেই সুখি মানুষ। আর সুখি হওয়া যায় সন্তুষ্টির মাধ্যমে। আর যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য ও জীবন-জীবিকার প্রতি এবং আল্লাহর দীনের অনুসরণে সন্তুষ্ট থাকবে আল্লাহ তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা ফাজর: ২৭-৩০)
৪) জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা না করা
নিজেকে সেলিব্রেটি করার চেষ্টা না করা ব্যক্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেলিব্রেটি হওয়ার নেশা জেগে ওঠলে আসল উদ্দেশ্য থেকে ছিটকে পড়বেন। কারণ জনপ্রিয়তা অর্জনের ইচ্ছা লোক দেখানো আমল অথবা অহংকারী হওয়ার পথ খুলে দেয়। ফলে মানুষের মন তার থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। হাদিসে এসেছ, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোনো আমল করে, আল্লাহ তাআলা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন। (বুখারি: ২/৯৬২; মুসলিম: ২/৪১২; তিরমিজি: ২/৬১; ইবনে মাজাহ: ২/৩১০)
সুতরাং এমন একটি নির্ভরতার বন্ধু সার্কেল তৈরি করুন, আপনি যাদের প্রতি আন্তরিক এবং যারা আপনার প্রতি অমায়িক। এতেই ব্যক্তিত্ব বাড়বে।
৫) হাসিমুখে ধীরেসুস্থে উত্তম ভাষায় কথা বলা
আগ্রহের সঙ্গে স্পষ্টভাবে কথা বলা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। তবে এক্ষেত্রে বিনয়ী হতে হবে। বিশ্বনবী (স.) সর্বোত্তম ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ছিলেন ঝাওয়ামিউলি কালিম। কথা বলতেন কম, কিন্তু তা ছিল ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন। এমন কোনো রসিকতা করতেন না, যাতে মানুষের সম্মান নষ্ট হয় বা মনে কষ্ট পায়। (সীরাতে রাসুল)
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি যদি কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে মানুষ আপনার থেকে দূরে চলে যেত’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, আমর মতে বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই। (হিলয়াতুল আউলিয়া ৩/৩৬৪)
৬) বাক্য ব্যবহারে সংযম
বেশি কথা বলা, মন্তব্য করা এবং বুঝে-শুনে বাক্য ব্যবহার না করলে মানুষকে লজ্জিত হতে হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) একাধিক হাদিসে মানুষকে বাক্যব্যয়ে সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মানুষ সকালে ঘুম হতে ওঠার সময় তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনীতভাবে জিহ্বাকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো। আমরা তো তোমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সোজা পথে দৃঢ় থাকো তাহলে আমরাও দৃঢ় থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য।’ (সুনানে আবি দাউদ: ২৪০৭)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাজে, আর যারা অনর্থক কথন থেকে বেঁচে থাকে।’ (সুরা মুমিনুন: ১-৩)
৭) ক্ষমা করা
ক্ষমা করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। ক্ষমা করলে ক্ষমাশীল ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম: ২৫৮৮)
৮) সেবা করা
মানবসেবায় রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম কর্জ দেয়, তাদের জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ (সুরা আল-হাদিদ: ১৮)
হাদিসে এসেছে, ‘দান করলে সম্পদ কমে না, যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তার মর্যাদা উন্নত করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৮৮)
৯) অবৈধ সম্পদের মোহ ত্যাগ
সম্পদের মোহ মানুষকে অন্যায় ও অবিচারে উদ্বুদ্ধ করে। যা ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করে। বিশেষ করে যখন অন্যের প্রাচুর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হবে।’ (সুরা তাকাসুর: ১-২)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ তার জন্য যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে। যে অর্থ জমায় ও তা গণনা করে রাখে। সে ধারণা করে যে, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে। কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামা নামক জাহান্নামে।’ (সুরা হুমাজা: ১-৪)
উপরোক্ত আমলগুলোর গুরুত্ব ও ফজিলত যেমন রয়েছে, তেমনি দুনিয়ায়ও মর্যাদা বেড়ে যায়, যা ব্যক্তিত্ববান মানুষের প্রেরণা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপরোক্ত আমলগুলো যথাযথভাবে করার তাওফিক দান করুন। আমিন।