ধর্ম ডেস্ক
০৮ জুন ২০২২, ০৯:১৬ এএম
হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। অমুসলিমরা তাঁকে পাগল ডাকত, আঘাত করত, কঠোর ভাষায় কথা বলত। অথচ নবীজি তাদের সঙ্গে এমন কোমল আচরণ করতেন, যা শুধু নিজ পরিবারের সঙ্গেই করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলছেন, আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন..(সুরা আলে ইমরান: ৩)
মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই সম্মান করতেন। সম্মান করার শিক্ষা দিতেন। তাঁর মনে অমুসলিমদের প্রতি কোনো ঘৃণা ছিল না। এমনকি কোনো ইহুদির লাশ দেখলেও সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যেতেন। একবার নবীজির পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়ালেন। উপস্থিত সাহাবারা বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলাইসাত নাফসা? অর্থাৎ, সেকি মানুষ নয়?’ (বুখারি: ১৩১২)।
মক্কা বিজয়ের পর তিনি ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। যারা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিত, তাদের হত্যা করলেন না, যারা তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল, তাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কার করলেন না। বরং সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিলেন। এটাই ছিল রাসুল (স.)-এর উদারতা ও মহনুভবতার দৃষ্টান্ত।
তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম: ২৩১৯)।
অথচ কিছু অমানুষ নবীজিকে নিয়ে কটূক্তি করছে। তাঁকে অমানবিক, সন্ত্রাসী, খুনি হিসেবে উপস্থাপন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, মুহাম্মদ (স.) জীবনে অনেকগুলো যুদ্ধ পরিচালিত করেছেন। তবে তা সাম্রাজ্য বিস্তার বা কোনো ধন-সম্পদ অর্জনের লোভে নয়। জাহেলিয়াতের শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই জাহেলিয়াতকে দূরীভূত করতে এবং সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিলেন। আজকের দুষ্টদের দেখলেই অনুমান করা যায়, বর্বর মানুষকে সভ্য করতে যুদ্ধগুলোর কতইনা প্রয়োজন ছিল। ওই যুদ্ধগুলো না করলে আজো মানুষ পশুর মতো থেকে যেত। হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি, কাফেলা লুট, নারী নির্যাতন কিছুই বন্ধ হতো না।
এরপরও শত্রুদের মারতে নবীজির মনে কেন জানি দয়া ও কোমলতা বিরাজ করত। যুদ্ধের সময়ও তাঁর ভেতরে কাজ করত অদ্ভুত এক অহিংস মনোভাব। তাই জীবদ্দশায় ২৭টির মতো বড় যুদ্ধ ও ৬০টির মতো ছোটখাটো যুদ্ধ পরিচালনা করার পরও কাউকে নিজ হাতে কতল করেননি।
তাঁর এই অহিংসা নীতি এখনও মুসলমানরা লালন করে বলেই অমুসলিমদের কোনো রকম ক্ষতির চিন্তা তারা করে না। কিন্তু এই মহানুভবতার অর্থ কি এমন হওয়া উচিত যে, সেই দয়ার নবীকে আঘাত করতে হবে?
যুদ্ধের সময় অমুসলিমদের মধ্যে যারা নিরপরাধ ও ধর্মীয় পণ্ডিত, তাদের সম্মানে নিজ সৈনিকদের নির্দেশ দিতেন। ‘শিশু, বৃদ্ধ, নারী, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে যেন মুসলিম বাহিনী কোনো অস্ত্র না ধরে।’ একইভাবে অমুসলিমদের প্রার্থনালয় ও সম্পদ যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারেও ছিল কঠোর নির্দেশ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নবী মুহাম্মদ (স.) ছিলেন এক অনন্য কালপুরুষ। নবীজির স্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে, তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ: ৫১২৩)।
যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতেন নবীজি। প্রিয়নবী (স.)-এর সমরনীতিতে অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না। তাই অল্প লোকক্ষয় ও সীমিত সময়ে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হত। যুদ্ধে যেসব অমুসলিম নিহত হতো, তাদের লাশ যেন বিকলাঙ্গ না করা হয়, সে ব্যাপারে নবীজি ছিলেন সদা তৎপর। আর যারা বন্দি হতো, তাদের সঙ্গেও করতেন কোমল ও সম্মানপূর্বক আচরণ।
নবম হিজরিতে আরবের বনু তাঈ গোত্রের সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ হলে তাঈ গোত্র পরাজয় বরণ করে পালিয়ে যায়। কিছুসংখ্যক লোক বন্দি হয়। বন্দিদের মধ্যে পৃথিবী বিখ্যাত দাতা হাতেম তাঈয়ের মেয়েও ছিলেন। নবীজি তাকে ডেকে বললেন, ‘হে তাঈ কন্যা! তোমার বাবা ছিলেন ঈমানদারের চরিত্রে উদ্ভাসিত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দাতা চরিত্রের মানুষ। যাও, তার খাতিরে তোমাকে মাফ করে দিলাম।’ তাঈকন্যা তখন নবীজিকে অনুরোধ করেন, তার সঙ্গে যেন তার গোত্রের সবাইকে মুক্তি করে দেওয়া হয়। নবীজি তাঈকন্যার সম্মান প্রদর্শনে সবাইকে মাফ করে দেন। এমনকি পথের খরচটুকুও দিয়ে দেন। এই ছিল অমুসলিমদের প্রতি নবীজির আচরণ।
অমুসলিমরা যেখানে মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করত, সেখানে নবীজি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিতেন সামান্য মুক্তিপণের বিনিময়ে। আর যারা এ সামান্য মুক্তিপণ দিতে পারত না, তাদের নিয়োগ দিতেন ভাষা শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে। বদরযুদ্ধে যেসব অমুসলিম বন্দি হয়ে মুক্তিপণ দিতে পারেনি, তাদের এ শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন যে, তারা প্রত্যেকে দশজন মুসলমানকে আরবি ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শেখাবেন।
যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যেন কোনো অমানবিক আচরণ না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য নবীজি সাহাবাদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘যে মুসলিম তার বন্দির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩২)।
নবীজিকে হত্যা করার জন্য অমুসলিমরা কত ষড়যন্ত্রই না করেছিল। লেলিয়ে দিয়েছিল দুষ্টু বালকদের। যার পবিত্র শরীরে মশা-মাছি বসাকে হারাম করা হয়েছে, সেই নবীজির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তায়েফের জমিন। ওহুদের ময়দানে হারাতে হয়েছে পবিত্র দাঁত। তারপরও তিনি তাদের জন্য বদদোয়া করেননি।
বরং সাহাবারা যখন রাসুল (স.) এর কাছে আবেদন জানাতেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।’ তখন নবীজি রক্তাক্ত চেহারা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘আমি অভিশাপ দেওয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ এরপর তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা করুন। তারা জানে না যে, তারা কী করছে।’ (মুসলিম: ২৫৯৯, ইবনে হিব্বান: ৯৮৫)।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) বলেন, রাসুলের যুগে আমার মা আমার কাছে এলেন, তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। তখন আমি রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা এসেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মবিমুখ (অমুসলিম)। আমি কি তাঁর আত্মীয়তা রক্ষা করব? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করো। (বুখারি: ২৬২০)
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় নবীজি কঠিন নির্দেশ দিতেন। কোনো গর্হিত কাজ না করার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি করে বলেছেন—
‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষালম্বন করব।’ (মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার: ৫৭৫০)।
মহানবী মুহাম্মদ (স.) আজীবন যে মানবপ্রেমের দীক্ষা দিয়েছেন, যে প্রেমের মাধুর্যে বাগান সাজিয়েছিলেন, সেই বাগানে আজ ঢুকে পড়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইরা। সেজন্যই সেই বাগানের অংশীদারদের মধ্যে অনৈক্য ও হিংসাবিদ্বেষের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তা না হলে নবীজির শত্রুরা সাবধান হয়ে যেত। পৃথিবী থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যেত হিংসা, অবমাননা ও অমানবিক আচরণ। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হেদায়েত দান করুন। সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।