ধর্ম ডেস্ক
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম
জাহেলিয়াতে ভরে গেছে পৃথিবী। আল্লাহ তাআলা নবীজিকে প্রেরণের জন্য এমন সংকটময় মুহূর্তটি বেছে নিলেন। আরবের অভিজাত গোত্র কোরাইশ বংশের অভিজাত ঘরে আবির্ভুত হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব দোজাহানের সর্দার রাহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)। কোরাইশ মূলত ইসমাইল (আ.)-এর বংশের একটি শাখা। মক্কাকেন্দ্রিক এ বংশটির নেতৃত্বে ছিলেন কুসাই বিন কিলাব।
হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ইন্তেকালের পর কয়েক শতক বনু ইসমাইলের হাতেই ছিল মক্কার নেতৃত্ব। এরপর তাদের দুর্বলতার সুযোগে বনু জুরহাম নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়। অতঃপর তারাই শাসন করে সুদীর্ঘকাল। এরই মধ্যে বনু খোজায়া নামের এক গোত্র যুদ্ধ-বিগ্রহ করে মক্কায় আবাস গড়তে সক্ষম হয়। বনু জুরহামকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করে তারা। তারাও ৩০০ বছর নেতৃত্ব দেয়। মূর্তিপূজা ও কাবায় মূর্তি স্থাপনসহ হাজারো অপকর্মের মূল হোতা তারা।
পরে পূর্বপুরুষদের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার মতো একজন বীরের জন্ম হয় কোরাইশ বংশে। তাঁর নাম কুসাই বিন কিলাব। তিনি নেতৃত্ব বেশ দক্ষ। বিশৃঙ্খল বনু ইসমাইলকে একত্রিত করে পূর্বপুরুষের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন তিনি। এই সঙ্ঘবদ্ধ বনু ইসমাইলকেই বলা হয় কোরাইশ। শুরু হয় কোরাইশের পথ চলা।
আরও পড়ুন: মুসলিম মানসে রবিউল আউয়ালের মহিমা
এরপর কুসাইর নাতি হাশেম আসেন মক্কার নেতৃত্বে। তাঁর হাত ধরেই কোরাইশের সোনালী অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি কোরাইশের আঞ্চলিক ব্যবসা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যান। শুরু হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন যুগ। হাশেমের অসাধারণ নেতৃত্ব কোরাইশকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রের মর্যাদায় আসীন করে।
হাশেমের ঘরে জন্ম নেয় মহান নেতা শাইবা। ডাকনাম আবদুল মুত্তালিব। মুহাম্মদ (স.)-এর দাদা তিনি। কোরাইশের শীর্ষস্থানীয় মর্যাদাবান নেতাদের মাঝে তিনি অন্যতম। তাঁর হাতেই পুনরুদ্ধার হয় বরকতময় জমজম। আর একে কেন্দ্র করে আব্দুল মোত্তালিব লাভ করেন আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা।
আব্দুল মোত্তালিবের ১০ ছেলে। তাদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর, ভদ্র ও লাজুক ছেলে হলেন আব্দুল্লাহ। তাঁকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন আব্দুল মোত্তালিব। কোরাইশ নেতাদের কাছেও আব্দুল্লাহর রয়েছে আলাদা মর্যাদা। তাঁর উজ্জ্বল তারুণ্য ও জাদুময় বাচনভঙ্গি যে কাউকে আকৃষ্ট করত।
আব্দুল্লাহ জন্য পাত্রী দেখলেন আব্দুল মুত্তালিব। কোরাইশের অভিজাত গোত্র বনু জোহরার সর্দারের মেয়ে- আমেনা বিনতে ওয়াহাব। রুপে ও গুণে অনন্য তিনি। লাজুকতা যেন তাঁর মজ্জাগত স্বভাব। বিনয় তাঁর অলঙ্কার। আরবের শ্রেষ্ঠ নারীদের অন্যতম তিনি। মহা আয়োজনের সম্পন্ন হলো আব্দুল্লাহ-আমেনার বিয়ে। এ মহীয়সী নারীকে জীবনসঙ্গিনী করে ঘরে তুলে আনলেন আব্দুল্লাহ।
আরও পড়ুন: নবুয়তের আগেই নবীজিকে চিনেছেন যারা
শুরু হলো আব্দুল্লাহ-আমিনার সুখের সংসার। কিন্তু তাঁদের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাস ছয়েক পর ব্যবসায় কাজে শামে যান আব্দুল্লাহ। কিন্তু কে জানত! এই দেখাই হবে শেষ দেখা। প্রিয়তম স্বামীকে ছেড়ে আমেনার দিন যেন কাটতেই চায় না। কেবল পথ চেয়ে থাকেন তিনি। কখন আসবেন স্বামী? কিন্তু তিনি আর এলেন না। এলো তাঁর মৃত্যু সংবাদ। ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে ইয়াসরিবে ইন্তেকাল করেছেন আব্দুল্লাহ।
আমেনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ইতোমধ্যে গর্বে এলো নতুন মেহমান। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। আহ! দুনিয়াতে আসার আগেই এতিম হয়ে গেল সন্তানটি। এখন কী হবে? এর ঠিক ৪০ দিন পর এলো সেই খুশির দিন। যার অপেক্ষায় নভোমন্ডল-ভূমন্ডলের ক্ষুদ্রকণা পর্যন্ত অধীর ছিল। দিনটি ছিল সোমবার। মায়াবী রাতের আঁধার চিঁড়ে উদ্ভাসিত হলো এক সুন্দর ভোর। এ মিষ্টি ভোরে ধরায় আগমন করেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও জ্যোতির্ময় নবজাতক হজরত মুহাম্মদ (স.)।
উল্লাসে মেতে উঠল কুল কায়েনাত। আকাশে বাতাসে তাঁরই আগমনধ্বনি। অসাধারণ সুন্দর নাতি পেয়ে আব্দুল মোত্তালিবও দারুণ খুশি। আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করলেন। নাম রাখলেন মুহাম্মদ। বিদ্যুৎগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে এ খুশির সংবাদ। মানুষের ঢল নামলো আমেনার ঘরে। সবাই বলতে লাগল, পূর্ণিমার চাঁদ নেমে এসেছে আমেনার কোলে।
হজরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা.)-এর মাতা হজরত ফাতিমা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (স.)-এর জন্মগ্রহণ মুহূর্তে আমি আমেনার কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম, বিবি আমিনার ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল এবং আকাশের তারকারাজি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার মনে হতে লাগল, তারকাগুলো যেন আমার ওপর এসে পড়বে।’ (ফাতহুল বারি: ৬/৭২৬)
হজরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুল (স.)-এর সম্মানিতা মাতা রাসুল (স.)-এর শুভজন্মক্ষণে এক নূর দেখেন, যার দ্বারা সিরিয়া এলাকার প্রাসাদগুলো উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠে।’ (মাজমাউজ জা জাওয়ায়েদ: ৮/২২২)