images

ইসলাম

বিদআত কেন প্রত্যাখ্যাত, পরিণাম কী?

ধর্ম ডেস্ক

১৫ মে ২০২২, ০৩:০০ পিএম

বিদআত শব্দটি আরবি। অর্থ হলো নব আবিস্কৃত ও নব উদ্ভাবন। এর অর্থ এভাবেও বলা যায়, পূর্বের কোনো দৃষ্টান্ত ও নমুনা ছাড়াই কোনোকিছু সৃষ্টি ও উদ্ভাবন করা। ইসলামের পরিভাষায় বিদআত বলা হয়, দীনের মধ্যে এমন কিছু সৃষ্টি করা, যা রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না; বরং পরে তা উদ্ভাবন করা হয়েছে।

ইমাম নববি (রহ) বলেন, পূর্ব নমুনা ছাড়া কোনো বিষয় আবিষ্কার করার নাম বিদআত। আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, ভিত্তিহীন কোনো জিনিস নতুন করে শুরু করার নাম বিদআত। বলা বাহুল্য, নব আবিষ্কৃত পার্থিব কোনো বিষয়কে বিদআত বলা যাবে না। যেমন শরিয়তে নিষিদ্ধ কোনো কাজকে বিদআত বলা হয় না; বরং তাকে অবৈধ, হারাম বা মাকরুহ বলা হয়।

বিদআত প্রথমত দুই প্রকার। ১) পার্থিব বিষয়ে বিদআত এবং (২) দীনের বিষয়ে বিদআত। পার্থিব বিষয়ে বিদআতের মূলনীতি হলো- তা বৈধ। আর দীনের ক্ষেত্রে সকল বিদআতই হারাম ও গোমরাহি।

এই বিদআতের বিরুদ্ধে মহানবী (স.) কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত বিষয়। (দীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত সবকিছুই বিদআত। প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম: ১৫৩৫; নাসায়ি: ১৫৬০)

বিদআত আবিষ্কারকারী যত বড় ধর্মীয় পণ্ডিতই হোক না কেন, ইসলামে তার নতুন আবিষ্কৃত আমল গ্রহণযোগ্য নয়। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দীনে (ইসলাম ধর্মে) কোনো নতুন কিছু সৃষ্টি করে, যা (যার ভিত্তি) তার মধ্যে নেই তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। (সহিহ বুখারি: ২৬৯৭)

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দীনে (ইসলাম ধর্মে) নতুন কোনোকিছু সৃষ্টি করে, যা (যার ভিত্তি) তার মধ্যে নেই তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।’ (সহিহ বুখারি: ২৬৯৭)

উল্লেখিত হাদিসের আলোকেই বিদআত প্রত্যাখ্যানের মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘হাদিসটি মুখস্থ করা, পাপাচার রোধে ব্যবহার করা এবং তা দ্বারা যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা উচিত।’ (মুখতাসার নাইলিল আওতার: ১/২৭৫)

আলবানি (রহ.) বলেন, ‘ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির মধ্যে হাদিসটি একটি উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন মূলনীতি এবং তা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অধিক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্যের (জামিউল কালিম) সাক্ষ্য বহন করে। কেননা হাদিসটি বিদআত ও নবপ্রবর্তিত বিষয়াদি বাতিল ও প্রত্যাখ্যান করার সুস্পষ্ট দলিল।’ (আদদিবাজু আলাল মুসলিম: ৪/৩২১)

তবে, তিন পর্যায়ের ভালো কাজ সুন্নাহ পরিপন্থী নয়। যেমন: ক) শরিয়তসম্মত কোনো ভালো কাজ অনেকের মধ্যে সর্বপ্রথম করা। খ) কোনো সুন্নত কাজ, যা উঠে গিয়েছিল, তা লোকমাঝে প্রচলিত করা অথবা জানিয়ে তার প্রচলন করা। গ) এমন কাজ, যা শরিয়তসম্মত ভালো কাজের মাধ্যম। যেমন দীনি মাদ্রাসা নির্মাণ, দীনি বই-পত্র ছাপানো ইত্যাদি। (ইবনে উসাইমিন)

আমল কবুলের দুই শর্ত

আলেমরা একমত যে, কোনো আমল ও ইবাদত দুটি শর্ত ছাড়া কবুল হয় না। তা হলো—

১) ইখলাস তথা নিয়তের বিশুদ্ধতা। যেমন—হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমলের ফলাফল নির্ভর করে নিয়তের ওপর।’ (সহিহ বুখারি: ১)

২). রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আনুগত্যপূর্ণ অনুসরণ। আলোচ্য হাদিস তার প্রমাণ।

বিদআত প্রচলনের মাধ্যমে শরিয়তকে অপূর্ণ আখ্যা দেওয়া হয়

বিদআতের পরিণতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেননা শরিয়তে কোনো কিছু নতুনভাবে শুরু করার ফলে বোঝা যায় যে, শরিয়ত অপূর্ণ। অথচ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা দীন পরিপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম...।’ (সুরা মায়েদা: ৮৯)

ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এ উম্মতের ওপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো আল্লাহ তাদের দীন পরিপূর্ণ করেছেন। সুতরাং তারা দীনের ব্যাপারে অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী নয়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৩৪)

আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের এ অবস্থায় রেখে গেছেন যে, কোনো পাখি শূন্যে ডানা মেলে উড়লেও তিনি আমাদের সে বিষয়ে জ্ঞানমূলক আলোচনা করতেন।’ (জামিউল আহাদিস: ৪১৬৬৭)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যেসব স্থায়ী জিনিস জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে তা তোমাদের জন্য স্পষ্ট করা হয়েছে।’ (সুনানে তিবরানি: ১৬৪৭)

আল্লামা ইবনে মাজিশুন (রহ.) বলেন, আমি মালিক (রহ.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে নতুন কিছু শুরু করে এবং তার মধ্যে মঙ্গল দেখে, সে মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর এ ধারণা করল যে তিনি তাঁর রিসালতের দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেননি। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং সে সময় যেসব বিষয় দীনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তা আজও দীনের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ (ফাতহুল কুবিল মাতিন: ১/৮৬)

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দীন

ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, হে লোক সকল! জান্নাতের নিকটবর্তীকারী এবং জাহান্নাম থেকে দূরকারী এমন কোনো জিনিস নেই, যা আমি তোমাদেরকে করতে আদেশ করিনি। আর জাহান্নামের নিকটবর্তীকারী এবং জান্নাত থেকে দূরকারী এমন কোন জিনিস নেই, যা আমি তোমাদেরকে করতে নিষেধ করিনি। (বায়হাকির শুআবুল ঈমান: ১০৩৭৬; হাকেম: ২১৩৬, সিলসিলাহ সহিহাহ: ২৮৬৬)

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘প্রত্যেক নবীর জন্য জরুরি যে, তিনি তাঁর উম্মতকে সেই কাজ বাতলে দেবেন, যা তিনি তাদের জন্য সবচেয়ে ভাল বলে জানবেন। (আল-ইহকাম: ১/৯০)

কেয়ামতের দিন বিদআতিরা লাঞ্ছিত হবে

হাদিসে এসেছে, বিদআতে জড়িত ব্যক্তি কেয়ামতের দিন চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। কিয়ামতের দিন রাসুল (স.) বিদআতি লোকদের হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন না। তিনি তাদের বলবেন, ‘যারা আমার দীনের পরিবর্তন করেছ, তারা দূর হও, দূর হও।’ (বুখারি: ৬৬৪৩)

মহান আল্লাহ নিজ নবীর ব্যাপারে বলছেন, ‘সে যদি কিছু রচনা করে আমার নামে চালাতে চেষ্টা করত, তবে আমি তাকে কঠোর হস্তে দমন করতাম এবং তার কণ্ঠশিরা কেটে দিতাম। তোমাদের কেউই তাকে রক্ষা করতে পারত না। (সুরা হাক্কাহ: ৪৪-৪৯)

যেখানে নবীজির ব্যাপারে মহান আল্লাহর এমন কথা, সেখানে বিদআতিদের শাস্তি কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘বিদআতের কারণে জাহান্নাম অবধারিত। কারণ রাসুল (স.) বলেছেন, ‘..প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম: ১৫৩৫; নাসায়ি: ১৫৬০)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করা থেকে দূরে রাখুন এবং বিদআত থেকে দূরে থাকার ও সহিহ সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।