ধর্ম ডেস্ক
১৫ মে ২০২২, ১২:৩০ পিএম
হজ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ফরজ। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, 'মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশে এ গৃহের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন' (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)। তবে, পুরুষের মতো আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্যবান হলেই নারীর ওপর হজ ফরজ হয় না, বরং নারীর জন্য কিছু অতিরিক্ত শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি।
স্বামী বা মাহরাম ব্যতীত মহিলাদের হজে গমন শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নয়, এতে হজ মাকরুহের সঙ্গে আদায় হয়ে গেলেও মহিলা গুনাহগার হবে। (আল জাওহারা: ১/১৫০)
আরও যেসব শর্ত পূরণ হলে নারীদের ওপর হজে গমন করা ফরজ এবং হজপালনে নারীদের বিশেষ বিধি-বিধানগুলো নিচে উল্লেখ ধরা হলো।
যেসব নারীর ওপর হজ ফরজ
আকল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া।
প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
স্বাধীন হওয়া।
সুস্থ ও সবল থাকা।
হজের পূর্ণ খরচ বহন করার সক্ষমতা থাকা।
হজের সফরে স্বামী বা মাহরাম (যে পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হারাম) সঙ্গে থাকা।
মাহরামের হজের খরচ সম্পন্ন করার সক্ষমতা থাকা। কেবল নিজের হজ করার সামর্থ্য থাকলেও নারীর জন্য হজ ফরজ হয় না। (বাহরুর রায়েক: ২/৩৩৯)
তবে, মাহরাম যদি ফরজ হজ করতে যায়, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে গেলে খরচ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা হলে (পরবর্তী ৩ মাস) ইদ্দত পরিপূর্ণ করা।
বিবাহিত নারীর ফরজ হজের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তবে অনুমতি নেওয়া মোস্তাহাব।
স্বামী যদি স্ত্রীর হজের যাবতীয় খরচ বহনের সক্ষমতা অর্জন করেন, এতে স্ত্রীর ওপর হজ ফরজ হয় না। স্ত্রীর যদি নিজ মালিকানায় হজ ফরজ হওয়ার মতো সম্পদ থাকে, তাহলেই নারীর ওপর হজ ফরজ হবে।
তবে, স্বামী যদি স্ত্রীর হজের সকল ব্যয়ভার বহন করে স্ত্রীকে হজ করান, এতে স্ত্রীর হজের ফরজিয়াত শেষ হয়ে যাবে।
নারীরা অন্য নারীর সঙ্গে মিশে হজ করতে পারবে না। টাকার ব্যবস্থা থাকার পরও উপযুক্ত মাহরাম না থাকায় হজ করতে না পারলে বদলি হজের অসিয়ত করে যাবে। মৃত্যুর পর তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ দ্বারা তা আদায় করা হবে। নারীর ওমরার ক্ষেত্রেও উপরুক্ত শর্তগুলোই প্রযোজ্য।
‘যে বছর হজ ফরজ হয়, ওই বছরই আদায় করে নেওয়া উচিত। অহেতুক হজ আদায়ে বিলম্ব করা বড় গুনাহ। একবার হজ ফরজ হলে, তা আর কখনো মাফ হয় না।’ (আহসানুল ফতোয়া, খণ্ড: ০৪, পৃষ্ঠা- ৫২৮)
নারীর হজ আদায়ের বিশেষ বিধি-বিধান
ইমাম আবুল হাসান সুগদি (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, হজের বিধানাবলিতে মহিলাদের বিশেষ ১১টি বিধান রয়েছে, যা সংক্ষিপ্তাকারে নিচে বর্ণনা করা হলো—
১) নারীর ওপর হজ ফরজ হওয়ার জন্য তার স্বামী বা মাহরাম থাকা আবশ্যক।
২) স্বামী বা মাহরাম থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রয়োজন ও দাবির নিমিত্তে তাদের হজের খরচও ওই মহিলার কাছে থাকা আবশ্যক।
৩) নারীরা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করতে পারবেন।
৪) স্বীয় চেহারা আবৃত না করতে পারলেও মাথা ঢাকতে পারবেন।
৫) তালবিয়া পুরুষগণ জোরে পড়া সুন্নত, নারীরা নিঃশব্দে পড়া সুন্নত।
৬) পুরুষগণ তাওয়াফের তিন চক্করে 'রমল' বুক উঁচিয়ে হাত নেড়ে বাহাদুরের ন্যায় হাঁটা সুন্নত, মহিলাদের জন্য তা সুন্নত নয়।
৭) খালি না পেলে হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া মহিলাদের সুন্নত নয়, তবে পুরুষশূন্য হলে দেবেন।
৮) খালি না পেলে মহিলাগণ সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ওঠা সুন্নত নয়, তবে পুরুষশূন্য হলে উঠবেন।
৯) সাফা-মারওয়ায় সাঈ করার সময় সবুজ চিহ্নদ্বয়ের মাঝে নারীরা সাধারণ গতিতেই হাঁটবেন, দ্রুতগতিতে নয়।
১০) আরাফায় অবস্থান ও তাওয়াফে জিয়ারতের পর ঋতুস্রাব শুরু হলে মহিলাগণ তাওয়াফে বিদা করা জরুরি নয়।
১১) ইহরাম খুলতে পুরুষের মতো মহিলাগণ মাথা মুণ্ডানোর বিধান নেই; বরং তারা আঙুলের অগ্রভাগ পরিমাণ চুল কাটবেন। (আন নুতাফ ফিল ফাতাওয়া, পৃ-২০৪)
ভিড়ের কারণে মহিলাদের বিধানে শিথিলতা
মহিলাগণ ভিড়ের দরুন মুজদালিফায় অবস্থান করার সুযোগ না পাওয়ায় মুজদালিফায় অবস্থান না করে মিনায় চলে গেলে তাদের ওপর দম (পশু জবাই) ওয়াজিব হবে না। (মুআল্লিমুল হুজ্জাজ, পৃ. ১৮৩)
মহিলাগণ দিনের বেলা ভিড়ের দরুন কঙ্কর মারার সুযোগ না পেলে তাদের জন্য রাতে কঙ্কর মারা জায়েজ আছে, এটি মাকরুহ হবে না। (রদ্দুল মুখতার: ২/২৪৮)
কিছু বিশেষ মাসয়ালা
ইহরামে থাকা অবস্থায় কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা নিষেধ। এ কারণে অনেক মহিলা মাসআলা না জানার কারণে হজের সময়ও মুখ খোলা রেখে চলেন। আসলে পরপুরুষ থেকে পর্দা করা সবসময়ের বিধান। এ কারণে হজের মতো মহান ইবাদতে পর্দার বিধানে শিতিলতা আরোপ বা বেপর্দা হওয়ার গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা জরুরি। হজ করার সময় মহিলাদের এমনভাবে চেহারা আবৃত রাখা উচিত, যাতে মুখমণ্ডলের সঙ্গে কাপড় লেগে না থাকে। বর্তমানে এক ধরনের ক্যাপ পাওয়া যায়,যা পরিধান করে সহজেই চেহারার পর্দা করা যায়।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে হজের ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। হাজিদের কাফেলা যখন আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করত, তখন আমরা মাথা থেকে চেহারার উপর চাদর ঝুলিয়ে দিতাম। যখন তারা আমাদেরকে অতিক্রম করে যেত, তখন চাদর সরিয়ে ফেলতাম। (আবু দাউদ: ১/২৫৪, হাদিস: ১৮৩৩)
হজ শুরু করার পর ঋতুস্রাব শুরু হলে শুধু তাওয়াফ ও সাঈ ব্যতীত অন্য সব আমল সম্পাদন করতে পারবেন, হজ শেষ করে স্রাব বন্ধ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন, অতঃপর বন্ধ হলে তাওয়াফ ও সাঈ করে হজ শেষ করবেন। (আল মাবসুত: ৪/১৭৯)
আরাফায় অবস্থান ও তাওয়াফে জিয়ারতের পর ঋতুস্রাব শুরু হলে মহিলাগণ তাওয়াফে বিদা করা জরুরি নয়, তবে স্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাওয়াফে বিদা আদায় করে আসা উত্তম। (আল মাবসুত: ৪/১৭৯, মুআল্লিমুল হুজ্জাজ, পৃ- ২০৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সকল নারী-পুরুষকে হজের সামর্থ্য অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে আদায় করার তাওফিক দান করুন। নারীদের বিশেষ বিধি-বিধান যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।