ধর্ম ডেস্ক
২৫ এপ্রিল ২০২২, ০৩:১৬ পিএম
জাকাত ফরজ ইবাদত এবং ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। পবিত্র কোরআনে যেখানে নামাজের কথা এসেছে, সেখানেই দেখা যায় জাকাতের কথা। ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যাকাত দিয়েছে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের নিকট। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা বাকারা: ২৭৭)
পবিত্র কোরআনে নামাজের পরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাকাতকে। মুমিনদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তারা এমন লোক- যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে, সৎকাজের আদেশ করে ও মন্দকাজে বাধা প্রদান করে।’ (সুরা হজ: ৪১)
জাকাত আরবি শব্দ। অর্থ- পবিত্র হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। পারিভাষিক অর্থে, ধনীদের ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহর নির্ধারিত হারে উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করা। জাকাত ইসলামের দৃষ্টিতে অনুদান নয় বরং গরিবের অধিকার। জাকাত একদিকে দাতার আত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে, তার ধন-সম্পদকেও পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে দেয়; অন্যদিকে দরিদ্রদের অভাব পূরণে সহায়তা করে এবং সম্পদে ক্রমবৃদ্ধি বয়ে আনে। তাই জাকাত একটি সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অনন্য হাতিয়ার। অধিক সওয়াবের আশায় অনেকে রমজান মাসে জাকাত আদায় করে থাকেন। যদিও জাকাতের সঙ্গে রমজানের সম্পর্ক নেই, তথাপি এই মাসে জাকাত আদায় করা অধিক সওয়াবের কাজ।
জাকাত কার ওপর ফরজ
নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে- এমন স্বাধীন ও পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ওপর জাকাত ফরজ। তবে এর জন্য শর্ত হলো- ১) সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। ২) সম্পদ বর্ধনশীল হতে হবে। ৩) নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ৪) সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ। ৫) ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ৬) নিসাব পরিমাণ সম্পদের সময় একবছর পূর্ণ হতে হবে।
কাকে জাকাত দিতে হবে
আল্লাহ তাআলা সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে জাকাত সংগ্রহ করে নির্ধারিত আটটি খাতে বণ্টন করার জন্য ইসলামি হুকুমাতকে নির্দেশ দিয়েছেন। তারা হলেন-
১. ফকির। বাংলায় তাদেরকে গরিব বলা হয়।
২. মিসকিন। যাদের আর্থিক অবস্থা গরিবদের চেয়েও খারাপ।
৩. আমেল। জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি।
৪. মন জয় করার জন্য। ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করা বা ইসলামের সহায়তার জন্য কারও মন জয় করার প্রয়োজন হলে তাকে জাকাত দেওয়া যাবে। ইসলামের শুরুর দিকে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। বর্তমানে এই খাতের খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবে নও-মুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য জাকাত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৫. দাসমুক্তি। তথা দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোক এবং ইসলামের জন্য বন্দিদের মুক্ত করাতে তাদের জন্য জাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে।
৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ। ঋণভারে জর্জরিত লোকেরা মানসিকভাবে সর্বদাই ক্লিষ্ট থাকে এবং কখনও কখনও জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের ঋণমুক্তির জন্য জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে ব্যয়। কোরআনের ভাষায় এ খাতের নাম বলা হয়েছে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পথে। আল্লাহর পথে কথাটি খুব ব্যাপক। মুসলমানদের সব নেক কাজ আল্লাহর পথেরই কাজ।
৮. মুসাফির। মুসাফির বা প্রবাসী লোকের বাড়িতে যত ধন-সম্পত্তিই থাকুক না কেন, পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে জাকাত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া যাবে।
কোন সম্পদ কতটুকু থাকলে কত অংশ জাকাত দিতে হবে
যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা, হাজারে ২৫ টাকা বা লাখে আড়াই হাজার টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে (আবু দাউদ: ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি: ৬২৩)। স্বর্ণ, রুপা, নগদ টাকা, ব্যবসায়ী পণ্য, গবাদিপশু এবং কৃষি ফসলের জাকাত দিতে হয়। নিচে কোনটার কী নিসাব- উল্লেখ করা হলো।
সোনা-রুপার নিসাব: সোনার নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি (তোলা)। রুপার নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন ভরি (তোলা)। সোনাও রুপা উভয়টি যদি কারও কাছে থাকে এবং এর কোনোটাই নিসাব পরিমাণ না হয়; তবে উভয়টির মূল্য হিসাব করে দেখতে হবে। মূল্য যদি একত্রে রুপার নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, অর্থাৎ ৫২.৫ ভরি রুপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তবেই জাকাত আদায় করতে হবে।
নগদ টাকার নিসাব: নগদ টাকার নিসাব হলো বাজার দর হিসেবে অন্তত সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের পরিমাণ টাকা এক বছরকাল জমা থাকলে এর জাকাত আদায় করতে হবে। হাতে ও ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে।
ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব: ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব হলো কোনো জিনিস বিক্রি করার উদ্দেশ্যে রাখা হলে তাকে ব্যবসার পণ্য মনে করা হবে। সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের সমান মূল্যমানসম্পন্ন ব্যবসার পণ্যের জাকাত দিতে হবে। বছরান্তে তখনকার বাজারদর হিসেবে মূল্য ধরতে হবে। খরিদমূল্য ধরলে চলবে না।
কৃষি ফসলের নিসাব: কৃষি ফসলের ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণির ফসলের নিসাব পৃথকভাবে হিসাব করে নিসাব পরিমাণ ফসল হলে উশর দিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ ধান যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, পাট যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, তাহলে ফসল তোলার সময়ই তার উশর দিতে হবে। তেমনিভাবে কলাই, সরিষা, মধু ইত্যাদি প্রতিটির নিসাব পৃথকভাবে ধরতে হবে। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো নিসাব নেই। খনিজ সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় থাকলে সম্পদ উত্তোলনের পরই হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। খনিজ সম্পদের জাকাতের হার হচ্ছে ২০ শতাংশ।
গবাদিপশুর নিসাব: নিজের কাজে খাটে এবং বিচরণশীল বা ‘সায়েমা’ নয় এমন গরু-মহিষ বাদ দিয়ে ৩০টি হলেই তার ওপর জাকাত দিতে হবে। জাকাতের হার হবে প্রতি ৩০টির জন্য একটি এক বছর বয়সের গরু এবং প্রতি ৪০টি বা তার অংশের জন্য দুই বছর বয়সের একটি গরু। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪০টি হলে একটি, ১২০টি পর্যন্ত দুটি, ৩০০টি পর্যন্ত তিনটি এবং এর ওপরে প্রতি ১০০টি ও তার অংশের জন্য আরও একটি করে ছাগল জাকাত দিতে হবে।
যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হবে না
১) সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফেআবি শায়বা: ৬/৪৪৭-৪৪৮)
২) নিজ ও অধীনস্থ পরিবারপরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ১০২০৭)
৩) গৃহের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ১০৫৬০)
৪) পরিধানের বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে, তবুও তাতে জাকাত ফরজ হয় না। (রদ্দুল মুখতার: ২/২৬৫)
৫) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়।
৬) ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ।
৭) ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।
জাকাত না দেওয়ার শাস্তি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুই পাশ কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসুলুল্লাহ (স.) তেলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য কেয়ামত দিবসে, অচিরেই অকল্যাণকর হবে, যা কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে।’ (বুখারি: ১৩২১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে সম্পদের জাকাত দেওয়া হয়নি, তাকে বিষধর সাপে রূপান্তর করে ওই সম্পদের মালিকের গলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে এবং সাপটি তাকে ছোবল দিতে দিতে বলবে, আমি তোমার প্রিয় সম্পদ, গুপ্তধন।’ (বুখারি: ১৪০৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জাকাতের সহিহ বুঝ দান করুন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক খাতে সঠিক নিয়মে জাকাত দিয়ে অর্থ-সম্পদকে পবিত্র করার তাওফিক দান করুন। আমিন।