images

ইসলাম

তায়েফে নবীজির ওপর অমানবিক আচরণ

ধর্ম ডেস্ক

০৯ আগস্ট ২০২৩, ০২:২৮ পিএম

তৎকালীন আরবে সৌদির পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল তায়েফ। সেখানকার লোকেরা স্থাবর সম্পত্তি ও ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিল। তাদের ছিল বড় বড় বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত-খামার। এছাড়াও তায়েফ নগরী ছিল বিখ্যাত প্রতিমা ‘লাত’-এর পূজা-অর্চনার কেন্দ্র, যেখানে নিয়মিত তীর্থযাত্রীরা আসত। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১৫২)

পবিত্র কোরআনে তায়েফ ও মক্কার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা বলে এই কোরআন কেন অবতীর্ণ হলো না দুই জনপদের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর।’ (সুরা জুখরুফ: ৩১)

তায়েফ মক্কা থেকে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত। নবুয়তের দশম বছর শাওয়াল মাসে প্রিয়নবী (স.) তায়েফ গমন করেন। সঙ্গে ছিলেন আজাদকৃত গোলাম ও পালকপুত্র জায়িদ ইবনে হারিসা (রা.)। আবু তালিবের মৃত্যুর পর মহানবী (স.)-এর ওপর কুরাইশদের অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে তিনি মক্কার বাইরে ইসলাম ও মুসলমানের নিরাপদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেখানে যান। তায়েফে ১০ দিন তিনি গোপনে, প্রকাশ্যে, একাকী ও সামগ্রিকভাবে দাওয়াত দেন। তিনি বাজারে দাঁড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ১/৩৬২)

নবীজির তায়েফ সফরের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। তায়েফ সর্দারদের একজন কুরাইশ গোত্রে বিয়ে করেছিল। তাছাড়া তায়েফের অদূরে বনি সাকিফ গোত্রে মহানবী (স.) দুধ পান করেছিলেন। দুধের আত্মীয় ও গোত্রীয় সম্পর্কের কারণে মহানবী (স.) তাদের থেকে সদাচার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তারা চরম দুর্ব্যবহার ও অমানবিক আচরণ করেছিল নবীজির সঙ্গে।

আমর ইবনে উমায়েরের তিন ছেলে আবদে ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব ছিল বনু সাকিফের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। মহানবী (স.) তাদের কাছে গেলে তাদের একজন বলে, ‘আল্লাহ যদি তোমাকে রাসুল হিসেবে পাঠিয়ে থাকেন, তবে তিনি কাবাঘরের গেলাফ খুলে ফেলুন।’ আরেকজন বলল, ‘আল্লাহ কি রাসুল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না?’ অন্যজন বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে কোনো কথাই বলব না। তুমি যদি তোমার দাবি অনুসারে সত্য রাসুল হও তাহলে তোমার কথার প্রতিবাদ করা বিপজ্জনক। আর তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলাই অনুচিত। তাদের কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (স.) বের হয়ে এলেন এবং তাদের অনুরোধ করলেন তারা যেন এসব কথা প্রচার না করে। কিন্তু তারা তা প্রকাশ করল এবং সাধারণ মানুষদের মহানবী (স.)-এর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা-১০৮)

তারা মহানবী (স.)-কে তায়েফ ত্যাগের নির্দেশ দেয় এবং ফেরার সময় উচ্ছৃঙ্খল বালকদের লেলিয়ে দেয়। বালকরা নবীজি (স.)-এর দিকে পাথর নিক্ষেপ করে এবং গালাগাল করে। শরীরের রক্তে নবীজির জুতা ভরে যায়। এ সময় জায়িদ (রা.) মহানবী (স.)-এর জন্য ঢালস্বরূপ হয়ে যান। যেদিক থেকে পাথর ছোড়া হচ্ছিল তিনি সেদিক থেকে তাঁকে আগলে রাখছিলেন। ফলে তাঁর মাথার কয়েক জায়গায় কেটে যায়। নবীজি (স.) কষ্টে মাটিতে বসে পড়লে হতভাগারা তাঁর হাত ধরে উঠিয়ে দিত এবং সামনে চলতে বলত। আর সামনে পা বাড়ালেই পাথর নিক্ষেপ করত। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১৪৩; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ১/৩৬২)

তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত মক্কার উতবা, রাবিয়া ও শায়বাদের বাগানে আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা মহানবী (স.)-এর পিছু নিয়েছিল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর তিনি একটি দোয়া করেন। যা ‘দোয়ায়ে মুস্তাদয়িফিন’ (অসহায় মানুষের দোয়া) নামে পরিচিত। তিনি দোয়ায় বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছেই ফরিয়াদ জানাই আমার দুর্বলতার, আমার নিঃস্বতার এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার। আপনি দয়ালুদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু। অসহায় ও দুর্বলদের প্রতিপালক তো আপনিই! আমার প্রতিপালকও আপনি। আপনি কার হাতে আমাকে সোপর্দ করেছেন। অনাত্মীয় রুক্ষ চেহারাওয়ালাদের কাছে অথবা এমন শত্রুর কাছে আমাকে ঠেলে দিচ্ছেন, যারা আমার ও আমার কাজের ওপর প্রবল। আপনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন তাহলে এরপরও আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না। তবে আপনার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও আফিয়াত আমার জন্য অধিক প্রশস্ত। হে আল্লাহ, আমি আপনার সত্তার নূরের আশ্রয় প্রার্থী, যা দিয়ে সমগ্র আঁধার আলোকিত হয়ে যায় এবং দ্বীন ও দুনিয়ার সব কিছু পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আপনি আমার ওপর কি অভিশাপ অবতীর্ণ করবেন বা ক্রোধান্বিত হবেন যে অবস্থায় আমি আপনার সন্তুষ্টি কামনা করি। সব শক্তি ও ক্ষমতা শুধু আপনারই। আপনার শক্তি ছাড়া কোনো শক্তি নেই।’

এ সময় আল্লাহ পাহাড়ের ফেরেশতাদের পাঠান। তারা মহানবী (স.)-এর কাছে দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত তায়েফের অধিবাসীদের পাহাড়ে পিষে ফেলার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মহানবী (স.) তা অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমি আশা করি, তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৫৮); নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১৫৪)

রাসুল (স.)-এর এ জবাবে তাঁর অনুপম ব্যক্তিত্ব ও উত্তম মানবিক চেতনার প্রকাশ রয়েছে। পুরো ঘটনায় নবীজির অপরিসীম ধৈর্য ও ক্ষমার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো ধরনের বদদোয়া করেননি, প্রতিশোধ স্পৃহায় মেতে ওঠেননি। বরং এ ঘটনার মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের স্বার্থে আত্মীয়-স্বজনের দেওয়া সীমাহীন কষ্টের বিপরীতে ধৈর্য ও ক্ষমার এক মহান শিক্ষা উম্মতে মুহাম্মদীকে দিয়ে গেলেন।

মক্কায় ফেরার পথে নাখলা নামক স্থানে অবস্থানের সময় আল্লাহ তাআলা জিনদের দুটি দল নবীজির কাছে পাঠান। তাদের আলোচনা সুরা কাহাফের ২৯-৩১ আয়াতে ও সুরা জিনের প্রথম ১৫ আয়াতে রয়েছে। মানুষের বিপরীতে জিনদের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবীকে সান্ত্বনা প্রদান করেন।

ওদিকে নাখলায় কয়েকদিন অবস্থানের পর নবীজি (স.) হেরা গুহায় আশ্রয় নেন। ওখান থেকে মুতয়িম ও তার গোত্রের লোকেরা কুরাইশদের মধ্যে ইসলাম প্রচার না করার শর্তে মহানবী (স.)-কে মক্কায় প্রবেশ করতে সাহায্য করে। তবে, শর্তে মক্কার বাইরের বিভিন্ন মেলা, হাজিদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১৪৬; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ১/৩৬৮)

মহানবী (স.) মুতয়িম ইবনে আদির এ অবদানের কথা স্মরণ করে বদর যুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে বলেন, আজ যদি মুতয়ি ইবনে আদি বেঁচে থাকত এবং এসব বন্দির ব্যাপারে সুপারিশ করত তবে আমি সবাইকে মুক্ত করে দিতাম। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত, আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, উহুদের চেয়ে কঠিন কোনো দিন কি আপনার জীবনে এসেছে? রাসুলুল্লাহ (স.) তখন তায়েফের দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেন। (সিরাতে মোস্তফা: ১/২৭১ ও ২৭৫)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির অতি দুঃখের দিনগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।