images

ইসলাম

তারাবি কত রাকাত?

ধর্ম ডেস্ক

১০ এপ্রিল ২০২২, ০৫:২৪ পিএম

হজরত উমর (রা.) এর যুগ থেকে এক জামাআতে ২০ রাকাত তারাবির প্রচলন শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে ইয়াজিদ ইবনে খুসাইফা (রহ) বলেন, সায়িব ইবনু ইয়াজিদ (রা.) বলেছেন, ‘তারা উমর (রা.)-এর যুগে রমজানে তারাবি ২০ রাকাত পড়তেন। সালাতে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সুরাসমূহ পড়তেন। উসমান (রা.)-এর যুগে অধিক সময়ে সালাতে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তারা লাঠিতে ভর করে দাঁড়াতেন।’ (আস সুনানুল কুবরা: ২/৪৯৬, বায়হাকি)

হাদিসটি সহিহ। ইমাম নববি ও বদরুদ্দিন আইনিসহ হাদিসশাস্ত্রের অনেক ইমাম এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। এছাড়াও মুহাম্মদ বিন কাব কুরজী বলেন, ওমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে লোকেরা রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতির পড়তো। (মুসাান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৫/২২৩)

ইয়াজিদ বিন রূমান বলেন, লোকেরা হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে ২০ রাকাত তারাবি এবং তিন রাকাত বিতির রমজান মাসে আদায় করতো। (মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার: ১৪৪৩, মুয়াত্তা মালিক: ৩৮০, সুনানে বায়হাকি কুবরা: ৪৩৯৪)

তারাবির রাকাতসংখ্যা নিয়ে হানাফি মাজহাবের আলেম ইমাম সারখাসি বলেন, ‘আমাদের মতে বিতির ছাড়া তারাবি ২০ রাকাত।’ (আলমাবসুত: ২/১৪৫)

ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘আবু-আবদুল্লাহ অর্থাৎ ইমাম আহমদ (রহ)-এর কাছে পছন্দনীয় মত হলো- তারাবি ২০ রাকাত। এই মতে আরো রয়েছেন ইমাম সাওরি, ইমাম আবু-হানিফা ও ইমাম শাফেয়ি। আর ইমাম মালেক বলেছেন, “তারাবি ৩৬ রাকাত।’ (আলমুগনী: ১/৪৫৭)

ইমাম নববি বলেছেন, ‘আলেমগণের ইজমা অনুযায়ী, তারাবির সালাত পড়া সুন্নত। আর আমাদের মাজহাব হচ্ছে- তারাবির নামাজ ১০ সালামে ২০ রাকাত। একাকি পড়াও জায়েজ, জামাতের সাথে পড়াও জায়েজ।’ (আলমাজমু: ৪/৩১)

এই হচ্ছে তারাবি নামাজের রাকাতের ব্যাপারে চার মাজহাবের অভিমত। এছাড়াও পূর্ববর্তী সাহাবি ও তাবেয়িগণের অনেকের কাছ থেকে ২০ রাকাত তারাবি পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। (আল-মুগনী: ২/৬০৪ ও আল-মাজমু: ৪/৩২)

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইমামগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ২০ রাকাত তারাবিই আদায় করেছেন। আর তাঁদের সবার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। ২০ রাকাত তারাবি সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) বলেন—

‘বিষয়টি প্রমাণিত যে, উবাই ইবনু কাআব (রা.) রমজানের তারাবিতে মুসল্লিদের নিয়ে ২০ রাকাত এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এজন্য অনেক আলিম ২০ রাকাতকে সুন্নত বলেছেন। কেননা, উমরের যুগে আনসার ও মুহাজির সাহাবিগণ ছিলেন। তাঁদের কেউ তখন আপত্তি করেননি।’ (মাজমুল ফতোয়া: ২৩/১১২, ১১৩)।

এ ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, ‘২০ রাকাত তারাবি খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নত এবং মুসলমানদের সম্মিলিত কাজ দ্বারা প্রমাণিত।’(মাজমুউল ফতোয়া: ২৩/১১৩)।

ইবনে তাইমিয়া মাজমুউল ফতোয়ার (২২/২৭২)-এ বলেন,

মূলত তারাবির জন্য নবী (স.) রাকাতের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করেননি। তবে তিনি রমজান ও রমজানের বাইরে তের রাকাতের বেশি পড়তেন না, কিন্তু তাতে কেরাত অনেক দীর্ঘ করতেন। উমর রা. যখন উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর ইমামতিতে জামাতের ব্যবস্থা করলেন, তখন উবাই ইবনে কাব (রা.) সাহাবিদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তবে তিনি যে পরিমাণ রাকাত বৃদ্ধি করেছেন, সে পরিমাণ কেরাত হালকা করতেন। কেননা এক রাকাতের মধ্যে কেরাত দীর্ঘ করার চেয়ে দীর্ঘ কেরাতকে ভাগ করে কয়েক রাকাতে পড়লে মুসল্লীদের জন্য সহজ হয়।

মালিকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা ইবনু আবদিল বার মালিকি (রহ) বলেন, ‘২০ রাকাত তারাবির কথা আলি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। শুতাইর ইবনু শাকল, ইবনু আবি মুলাইকা, হারিস হামাদানি ও আবুল বুখতারি থেকে ২০ রাকাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। আর তারাবির সালাত ২০ রাকাত হওয়া জমহুর আলিমের মত। আর ২০ রাকাত হওয়া কুফাবাসী, ইমাম শাফেয়ি (রহ) ও অধিকাংশ ফকিহের মত। উবাই ইবনু কাআব (রা.) থেকে সহিহভাবে ২০ রাকাত প্রমাণিত।’ (আল ইসতিজকার: ২/৭০)

হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে কুদামা মাকদিসি (রহ) বলেন, ‘ওমর (রা.) যা করেছেন এবং যে ব্যাপারে সকল সাহাবি একমত হয়েছেন, সেটির অনুসরণ অধিক উত্তম।’(আল মুগনি: ২/৬০৪)

এছাড়াও মক্কা-মদিনায় তারাবির নামাজ এখনও ২০ রাকাতই পড়া হয়। হজরত জাবের বিন আব্দুল্লাহসহ একাধিক সাহাবি ২০ রাকাত তারাবি জামাতের সাথে পড়েছেন, অথচ এর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি।

কুফায় ২০ রাকাত তারাবি পড়া হয়। কুফায় হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) ২০ রাকাত তারাবি এবং তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। (মুখতাসার কিয়ামুল লাইল: ১৫)

বসরায়ও ২০রাকাত তারাবি। হজরত ইউনুস রহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবুল আশআস (মৃত্যু ৮৩ হিজরি) এর ফেতনার পূর্বে জামে মসজিদ বসরাতে দেখেছি যে, হজরত আব্দুর রহমান বিন আবি বাকরা (মৃত্যু ৯১ হিজরি), হজরত সাঈদ বিন আবিল হাসান (মৃত্যু ১০০ হিজরি) এবং হজর ইমরানুল আব্দি লোকদের পাঁচ তারাবি (২০ রাকাত) পড়াতেন। (কিয়ামুল লাইল: ১৫৮)

কোনো ইসলামি রাজত্বেও ২০ রাকাত তারাবিকে অস্বিকার করা হয়নি। সবাই স্বীকার করেছেন যে, ২০ রাকাত তারাবি খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নত। ২০ রাকাতের ব্যাপারে সাহাবিগণের ইজমা তথা ঐকমত্য রয়েছে। তাই তারাবিকে ২০ রাকাত থেকে কমিয়ে আনা দলিলভিত্তিক নয়, যৌক্তিকও নয়। সুতরাং খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত আঁকড়ে ধরাটাই মুমিন ‍মুসলমানের জন্য বাঞ্ছনীয়।

রাসুল (স.) বলেন, ‘আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৬০৭, তিরমিজি: ২৬৭৬, মুসনাদে আহমদ: ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২)

মনে রাখা জরুরি, আল্লাহ তাআলা তারাবির বিধান দিয়েছেন রমজান মাসেই। তারাবি অন্য সময়ে পড়া হয় না। তাই তারাবি বাদ দেওয়া বা কম পড়া এতে কোনো বিশেষ উপকার নেই। বরং হাদিসে এসেছে—

‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তার অতীতের গুনাহগুলো আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেবেন।’ (বুখারি: ৩৬)

তাছাড়া শরয়ি ওজর ছাড়া তারাবির নামাজ ছেড়ে দেওয়া মাকরুহে তাহরিমি। তাই অবহেলাবশত তারাবি না পড়া মুমিন মুসলমানের অনুচিত। (কিতাবুল মাবসুত: ২/১৪৫, রদ্দুল মুখতার: ১/৬৫৩, ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৫/৭৭)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তারাবি নামাজের ব্যাপারে যাবতীয় ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা করুন। সুন্নাহভিত্তিক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।