ধর্ম ডেস্ক
৩০ জুন ২০২৩, ০৭:০১ পিএম
হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। হজ ঐক্যের প্রতীক। হজের মাধ্যমে মুসলমানরা ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের শিক্ষা লাভ করেন। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কাবা প্রাঙ্গণে ছুটে আসা মুসলমানদের মধ্যে বর্ণ ও ভাষার ভেদাভেদ নেই। সব মতভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে দণ্ডায়মান হয়ে একই কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক।’
আরাফাতের মাঠে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান করেন। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেন। সাফা-মারওয়া সায়ি করেন। মিনায় কোরবানি করেন। তদ্রূপ হজের পরও তাদের মধ্যে মতভেদ ও মতানৈক্য থাকা উচিত নয়। আমাদের পরিচয় হওয়া উচিত আমরা সবাই মুসলমান।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘হে মুু’মিনরা! তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো, পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩) হজ্জের শিক্ষা ও তাৎপর্য, হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, হজ্জের ফরজ কয়টি
হজে সমতার শিক্ষা লাভ করেন মুসলমানরা। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো ও নানা দেশের নানাভাষী মানুষ ইহরাম অবস্থায় সাদা কাপড় পরিধান করে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করার এ দৃশ্য মমতা ও অভিন্নতার শিক্ষা দান করে।
হজে লাভ হয় ত্যাগের শিক্ষা। হজরত ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.) ও হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগ, কোরবানি, আত্মসমর্পণ ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুমহান ঐতিহ্য আল্লাহপ্রেমিক মানবের হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে। হজ ও কোরবানি এ ত্যাগের শিক্ষা দেয়। কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য প্রিয়তমের জন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়া। পশু কোরবানি একটি প্রতীক মাত্র। কোরবানির মাধ্যমে মনের সব কুপ্রবৃত্তিকে চিরতরে বিদায় করা এবং চরিত্রের সব কুস্বভাব পরিত্যাগ করার মাধ্যমে মহান রবের কাছে নিজের সব উচ্চাভিলাষ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করাই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য।
মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অনুপম শিক্ষা লাভ করেন হাজীরা। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘সব মুসলমান ভাই ভাই।’ তার জ্বলন্ত নিদর্শন হজব্রত পালন। আরাফাতের ময়দানে যেন সবাই একই মায়ের সন্তান। একই ইমামের পেছনে সালাত আদায় করে একই স্রষ্টার কাছে দোয়া করেন। হজ বিশ্বমুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার করে। হজ শেষ করে নিজ নিজ দেশে গিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।’
আল্লাহর পবিত্র ঘর দেখা থেকে শুরু করে বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত প্রতিটি কাজই আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ, বিশ্বমুসলিমের ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির প্রশিক্ষণ। হজের মাধ্যমে একজন হাজী নিজেকে জান্নাতে যাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। তাই মহানবী (স.) বলেছেন, ‘মকবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়’। (বুখারি: ৩৭৭১)
শয়তানকে শয়তান হিসেবে বিবেচনা করা হজের অন্যতম শিক্ষা। হজে প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারতে হয়। পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ সুরায় সর্বশেষ আয়াতে দুই প্রকার শয়তানের কথা উল্লেখ আছে, ‘এই দুই ভয় হলো জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান।’ (সুরা নাস: ৬)। এছাড়া রয়েছে নফস শয়তান। এই তিন শয়তানের প্ররোচনা ও তাড়না থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মনোজগতে শয়তানি শৃঙ্খলবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার এবং সব ধরনের শয়তানি ভাব ও প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে একমাত্র বিবেকের অনুসরণে মহান আল্লাহর ইবাদত তথা আনুগত্য করাই হলো শয়তানকে পাথর মারার মূল রহস্য।
তাওহিদের শিক্ষা ধারণ করেই হজ থেকে ফিরতে হবে। তাওহিদের ইমাম হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আচরণ-উচ্চারণ তো এই ছিল, ‘আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সুরা আনআম: ৭৯)
হজ থেকে ফিরে করণীয় হজ পরবর্তী করণীয়, হজের পরে আমল
সুতরাং হজ থেকে ফিরতে হবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও তাওহিদের দীক্ষা নিয়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গেও নেই।’ (সুরা তাওবা: ৩)
হজ কবুল হওয়ার নিদর্শন হলো, এর ফলে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়। হজ করার পর যার জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। (আপকে মাসায়েল: ৪/২৫)
যারা হজের শিক্ষা লাভে ধন্য হন, তারাই প্রকৃত হাজি। হজ ইবাদত, এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স বা পদ–পদবি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়।
হজের পরে হাজীদের কাজে–কর্মে, আমলে–আখলাকে, চিন্তাচেতনায় পরিশুদ্ধি অর্জন করা বা পূর্বাপেক্ষা উন্নতি লাভ করতে হবে। হজ করা বড় কথা নয়; জীবনব্যাপী হজ ধারণ করাই আসল সার্থকতা।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হজ ও ওমরার জন্য গমনকারীরা আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহমান। তাঁদের দোয়া কবুল হয়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথের যোদ্ধা, হজ ও ওমরা পালনকারী আল্লাহর অতিথি। আল্লাহ তাদের ডেকেছেন এবং তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাই তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি তাদের তা প্রদান করেন।’ (ইবনে মাজাহ: ২৮৯৩)
সুতরাং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের সাথে জীবন পরিচালনা করতে হবে প্রত্যেক হাজীকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, আনুগত্যে নতশির হও, তখন সে (সঙ্গে সঙ্গে) বলল, আমি রাব্বুল আলামিনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। (সুরা বাকারা: ১৩১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সম্মানিত হাজিদের প্রত্যেককে তাঁর করণীয়গুলো আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।