ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৭ মে ২০২৩, ১১:২৬ পিএম
আমি সেবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ভ্রমণে বেরিয়েছি। বিয়ে করিনি তখন, বান্ধবী নেই বললেই চলে। বোটে করে আন্দামান দ্বীপপু্ঞ্জ ঘুরে ঘুরে দেখছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন যাত্রী নিয়ে নৌকার মাঝি এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যায়। আজ মালয়েশিয়ার একটি বড় দ্বীপে যাব। সেখানে থাকব একরাত, তারপর থাইল্যান্ডের ফুকেট দ্বীপে ফিরব। বেশ দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণ। আমার সমবয়সী এক মডার্ন এরাবিয়ান মেয়ে, সেও সেদিন একই বোটে। এরাবিয়ান মেয়ে একা একা, তারপর শরীরের কাপড়চোপড় দেখে মনে হচ্ছে না যে সে সরাসরি আরব দেশ থেকে এসেছে। থাকে নিশ্চয় ইউরোপ বা আমেরিকায়।
বোট ছাড়ার কিছুক্ষণ আগেই আমার পাশে এসে বসার অনুমতি চাইল। আমি শুধু বললাম প্লিজ। মেয়েটি শুরুতেই বেশ খোলামেলাভাবে আলোচনা শুরু করল। ভাবলাম, তাহলে কথা বলতে বলতে আর আন্দামান দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাবে। এতক্ষণে জানা হয়নি আমাদের পরিচয়। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম ইলাফ। আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকি, তবে আমার জন্মভূমি সৌদি আরবের মদিনা শহরে। আমেরিকার ইউসিএলএ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি। চাকরি করব নাকি বাবার দেশে ফিরে যাব- এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবলাম পৃথিবীটাকে একটু ঘুরে দেখি। তাই আমার এই বিশ্বভ্রমণ। তবে বিশ্বের সব দেশ নয়, শুধু ইউরোপসহ এশিয়ার কিছু দেশ যেমন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং পরে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ব্যাক টু সানসেট বুলেভার্ড অথবা সৌদির মদিনা শহরে, বলে হাসতে লাগল।
আমি তার কথা শুনছি বটে, তবে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন অন্য বিষয়। যেমন মক্কা, মদিনা এসব তো মুসলিম জাতির জন্য এক হলি প্লেস। তারপর আরবের অবিবাহিত যুবতী সুন্দরী নারী, বসে আছে আমার পাশে। ভাবতেই কেমন যেন গা শিউরে উঠছে। ভদ্রতার খাতিরে নিজের পরিচয় কোনোমতে শেষ করে ইলাফের মদিনা শহর এবং সেখানকার সব বিষয় জানার জন্য বরং বেশি আগ্রহী হয়ে গেলাম। খুব জানতে ইচ্ছে জেগেছে তার জীবন কাহিনী। কিভাবে এবং কেন সে মদিনা ছেড়ে আমেরিকায় এবং কেনই বা একা বিশ্বভ্রমণ করছে? এসব বিষয় জানার কৌতুহল মনে তীব্র আকারে ধারণ করেছে।
সময়টি হবে ১৯৮৭ সাল, আজকের মতো প্রযুক্তির যুগ নয়। সৌদি আরব, মক্কা এবং মদিনা সম্বন্ধে যা শুনেছি মুরব্বিদের থেকে, সেটা ছাড়া অন্য কিছু জানার সুযোগ তখন এ যুগের মতো ছিল না। সুযোগ যখন এসেছে জীবনে একবার, জানতে হবে অনেক কিছু। প্রথমে ভেবেছিলাম বোটের সময় কিছুটা বোরিং হবে, এখন মনে মনে ভাবছি সময় মনে হয় দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। সব কিছু জানা যাবে না। কি জিজ্ঞেস করতে কি উল্টাপাল্টা জিজ্ঞেস করে ফেলি এবং শেষে দেখা গেল ঝামেলায় পড়লাম! দরকার নেই বাবা। আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার কি দরকার? এমন করে ভাবছি মনে মনে। এর মধ্যে ইলাফ এটা সেটা বলছে আর আমি উত্তর দিচ্ছি। তবে আমার মন তখন নানা কথা বলছে।
ইলাফ হঠাৎ নাম ধরে বলছে, রহমান কিছু যদি মনে না কর তবে আমি কি তোমাকে আমার স্বল্প সময়ের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করতে পারি?
না চাইতেই বৃষ্টি!
আমি সব কিছু ঠিকমতো শুনছি তো? নাকি ভিমরতিতে ধরেছে আমাকে, যে যেটা মনে মনে ভাবছি সেটাই শুনছি? মাথাটাকে একটু নাড়া দিয়ে ইলাফকে বললাম, আমাকে একটু চিমটি দাও তো?
সে বলল, কেন?
আমি বললাম, আমি ঠিক আছি কিনা জানতে চাই।
সে চিমটির পরিবর্তে স্পেনিশ স্টাইলে মুখে একটু আদর করে বলল, কি সব কিছু ঠিক আছে?
আমি একটু লজ্জা পেয়েছিলাম বটে, তবে কিছু না চাইতে পাওয়া, আগে এমনটি ঘটেনি। তাই বেশ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম সেদিন সেই ক্ষণিকে।
যাই হোক, অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা বলতে বলতে সময় শেষ, বোট এসে লাংকাউভি আইল্যান্ডে (Langkawi Island) থেমে গেল।
এবার বিদায় নেওয়ার পালা।
ও’মা বিদায় পড়ে থাক, ইলাফ নিজ থেকে বলতে শুরু করল, তোমাকে পেয়ে কি যে ভালো লাগছে! আজ দুজনে মনের আনন্দে ঘুরব। আমার না প্রায় একমাস ভ্রমণের সময় পার হয়ে চলছে, কারও সাথে মনের মতো করে মেশা হয়নি, এমনকি কথা বলাও হয়নি। কি যে ভালো লাগছে তোমাকে পেয়ে।
আমি সুইডেনে একে তো গেস্ট স্টুডেন্ট, তারপর পার্টটাইম জব করে লেখাপড়ার খরচ যোগাই, ছোট ভাইবোনের কিছু সাহায্য করি। সবকিছুর পরও খুব অল্প এবং সীমিত বাজেটের মধ্যে আমার এই জার্নি, ক্ষণিকের বান্ধবীর সঙ্গে লাংকাউভি আইল্যান্ড কিভাবে ঘুরব? এটা ভাবতেই নিজের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে তখন। এমন সময় মিরাকলের মতো আকস্মিক ঘটনা ঘটতে শুরু হলো। মিরাকলের কথা শুনেছি, জীবনে মিরাকলের সুযোগ আসেনি, তবে সেদিন এসেছিল। ইলাফ নিজ থেকেই দিব্বি বলতে শুরু করল, রহমান তোমাকে বোটেই বলেছি, আমি তোমার একজন ভালো বন্ধু হতে চাই, তোমাকে মনের কথা বলতে চাই, আমার গোপন কথা শোনাতে চাই।
আমি বললাম, কেন, আমি তো না বলিনি তখন?
তাহলে শোন, আমি বড় লোকের মেয়ে। তুমি ভাবতে পারো আমি ভ্রমণে অর্থ দিয়ে সঙ্গী কিনতে চাই। আমার সম্পর্কে তোমার এমন একটি খারাপ ধারণা হোক সেটা আমি চাই না।
আমি বললাম, কি করতে হবে বল আগে শুনি!
ইলাফ বললো, আমি তোমার সাথে ঘুরতে চাই, তুমি যা করবে তাই করব, তুমি যা খাবে তাই খাব, তুমি যে হোটেলে থাকবে সেখানে থাকব। আমি সব ঠিকঠাক মতো শুনছি। তবে হোটেলের কথা বলতেই বললাম, এক রুমে?
ইলাফ বললো, হ্যাঁ।
আমি তখন বললাম, আমি তো হোটেলই নেইনি। ভাবছি, খোলা আকাশের ওই মিটিমিটি তারার আলোতে লাংকাইভি আইল্যান্ডের বালুতে রাত কাটাব। পারবে এসব করতে?
ইলাফ বলল, তাহলে আজ পরীক্ষা হয়ে যাক পারব কিনা। তবে আমরা সবকিছু ফিফটি ফিফটি শেয়ার করব। ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’ মানে ইলাফের কথাটি শুনে শান্তি এবং স্বস্তি পেলাম।
হঠাৎ দেখি রাস্তায় ডাব, কিনলাম দুটো। ইলাফ জীবনে ডাবের পানি পান করেনি। বললাম পান কর, সমস্যা নেই। ডাবের পানি পান করে বলল, জীবনে অনেক পানি পান করেছি, এমন অমৃত পানি এর আগে পান করিনি। শুনে বেশ ভালোই লাগল।
আমরা দুজনে হাঁটছি এবং নানা বিষয়ের ওপর কথা বলছি। এদিকে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। এমন সময় ইলাফ বলে বসল, রহমান, যদি কিছু মনে না কর তবে আমার সঙ্গে আমার হোটেলে চল। আমি একা একা চলাফেরা করছি, তাই আগেভাগে হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছি। তবে কথা দিচ্ছি আমরা চাঁদের আলোতে লাংকাউভি আইল্যান্ডের শেরাটন হোটেলের সমুদ্র সৈকতে এক সঙ্গে ঠিক তোমার মনের মতো করে একটি পরিবেশে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেব।
আমি রাজি হয়ে গেলাম, একটি টুকটুক মানে রিকশা করে শেরাটন হোটেলে এসে হাজির হলাম।
ইলাফ রিসিপশনে গিয়ে বলল, আমরা দুজনে সাগর পাড়ে সময় কাটাব তার জন্য প্লিজ ব্যবস্থা কর। হোটেল কর্তৃপক্ষ চা কফিসহ ডাব এবং আমাদের বসার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করে ফেলল অল্প সময়ের মধ্যে। এতক্ষণে রাত বারোটা বেজে গেছে। রাতে অনেক কথা হয়েছিল তবে যে কথা বলেছিল ইলাফ তার ব্যক্তি জীবনের ওপর সেটা ছিল এরকম- ইলাফ তার আমেরিকান বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ব্রেকআপ করে মূলত একা একা বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। ইলাফের পরিবার সব মেনে নিয়েছে শুধু মেনে নিতে পারেনি তার বয়ফ্রেন্ডকে, কারণ সে ছিল ইহুদি। আমি শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, সমস্যা কোথায়? উত্তরে ইলাফ শুধু বলেছিল, সমস্যা আমার নয়, বাবা-মায়ের। তারা সব মানতে রাজি, শুধু বয়ফ্রেন্ড ইহুদি এটা ছাড়া।
আমি সুইডেনে থাকি, এখানকার বেশিরভাগই খ্রিস্টান। আমি কখনও এদের ধর্ম, বর্ণ নিয়ে যুগে ভাবি না। ভাবি আমার নিজের ধর্ম নিয়ে, ভাবি দুর্নীতি, মনুষ্যত্ববোধ এবং অনীতি নিয়ে।
ইলাফ আমার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করল। ইলাফের সঙ্গে একদিন এক রাত ছিল আমার জীবনের একটি ঘটনা যা ঘটেছিল বহু বছর আগে। আমার প্রতি ইলাফের কিছুটা দুর্বলতা লক্ষ্য করেছিলাম। সম্পর্কের মোড় ঘুরতে পারত সেদিন এবং পরে। কিন্তু বন্ধু হতে চেয়ে কিভাবে প্রেমিক বলে গণ্য হব! কেন যেন দুটি মন এক জায়গা হলেও সে মন দুটি জুটি বাঁধার মতো হয়নি সেদিন রাতে। তাই বিদায়বেলা কথা দিয়েছিলাম, যোগাযোগ থাকবে। যোগাযোগ ছিল বন্ধু হিসেবেই, কারণ সব ফুল ফোটে না, আবার ফুল ফুটলেও ফল হয় না। আমার জীবনের বিশাল পরিবর্তন ঘটে সে সময়। সম্পর্ক তিলে তিলে বিলীন হয় যায় সময়ের সাথে। আজ এত বছর পরে ইলাফের কথা মনে পড়েছে! আজও মনে হয়, সহসা কখনও/জলে ভরা দু'টি ডাগর নয়নও/ক্ষণিকেরও ভুলে সেই চাপা ফুলে/ফেলে ছুটে যাওয়া লাজে…তবু মাঝে মাঝে আশা জাগে কেন/আমি ভুলিয়াছি ভোলেনি সে যেন..!
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
/জেএম