২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮ এএম
সবটুকু তাপ শুষে নেওয়া শীত। পেঁজা তুলোর মতো তুষার পড়লো শনিবার রাতভর। বিন্নি ধানের খইয়ের মতো ছড়িয়ে রইল। সবুজ ঘাসের গায়। গাছের পাতায়। গির্জা, ফরাসিরা বলেন, ইগলিস, তার চূড়ায় বড় ঘড়িটার ওপর। সর্পিল ট্রামপথ, যাত্রী ছাউনি। কিংবা পথের পাশে দাঁড় করানো গাড়ির ছাদ আড়াল হয়েছিল নারকেল গুঁড়োর মতো শুভ্রতায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পারি হয়ে উঠেছিল এক টুকরো শুভ্রনগরী।
কাগজে-কলমে শীতের আগমনের ঢের বাকি। তা প্রায় মাসখানেক । এরই মধ্যে হাঁড় কাঁপাচ্ছে হিমাগম। হাত দুটো বের করার জো নেই। জমে বরফ হবার উপক্রম। এর মাঝেই রাতদুপুরে তুষারস্নানে বেরিয়েছেন পারিজিয়ানরা। বছরে এমন উপলক্ষ যে খুব একটা আসে না বারবার। ঢাকার আদি নিবাসীরা যেভাবে ঢাকাইয়া নামে খ্যাত, পারির বাসিন্দারা তেমন পারিজিয়ান। এনিয়ে তাদের গর্বেরও অন্ত নেই।
সারারাতের হিমপাত মিলিয়ে যেতেও সময় লাগেনি খুব। রোববার শেষরাতে ছাইরঙা আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। তাতেই বরফের ফুল গলে পানি। অবশ্য রোববার দিনভরই কেঁদেছে পারির আকাশ। নিত্যজীবনেও দাঁত বসিয়েছে এই হিমশীতলতা। ছুটির দিনটি অনেকের কেটেছে চারদেয়ালে বন্দি হয়ে। কেউ কেউ আবার মেতেছিলেন রেস্তোঁরার আড্ডায়।
শতবর্ষী দালান, আধুনিক স্থাপত্যের পাশাপাশি অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই শহরের আভিজাত্যেরই অংশ। যদিও হেমন্তের শেষভাগে এই শোভায় ছেঁদ পড়েছে অনেকটাই। মদনটাক পাখির মতো প্রায় গাছের চাঁদি ফাঁকা। ম্যাপল, চেস্টনাটের ঝড়া পাতায় ঢেকে আছে পথ। যেন খরতাপ দুপুরে বাড়ির উঠোন। ধান শোকানোর মতো করে মেলে দিয়েছে কেউ।
জমে যাওয়া হিমের দাপট দিনে যতটা না, রাতে ততটাই। রাতের পারির মোহনীয়তার প্রশংসা বিশ্বজোড়া। বলা হয়, আলোর শহর। তার চাইতেও রাতের আকাশের গাঢ়ো নীলের তুলনা হয় দূর থেকে দেখা সমুদ্রের মতো। পারির অলংকার স্থাপত্যগুলো সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই জড়িয়ে নেয় নরম আলোর আলোয়ান। সেই আলো ঠিকরে পড়ে পথে। কাঁচের গুঁড়োর মতো সেই দ্যুতি চিকচিক করে খর্বকায় গাছগুলোর পাতায়-লতায়। পাথরের বেঞ্চিতে ঝরে পড়া মাহোনিয়ার হলদে ফুলের রূপও ধরা দেয় সেই আলোয়। কিংবা পুঁতির মতো থোকায় থোকায় টকটকে নন্দিনা ডমেস্টিকা ফল। এখানকার মানুষ যাকে, বঁবু সাকখে বা পবিত্র বাঁশা বলে চেনে, নিয়ন আলোয় ঠাওর হয় হালকা কালচে বর্ণ।
হাঁটুর নিচ অবধি নেমে যাওয়া লম্বা কোট, নাতিদীর্ঘ জ্যাকেট কিংবা উলের বোনা উষ্ণ বসনে বন্দোবস্ত শীতের। অন্যদিনের তুলনায় রোববার সন্ধ্যায় পথে মানুষের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। হিমের ঠমকে ঘরমুখো অনেকেই। তারপরও গুনেগুনে পা ফেলা পারিজিয়ানদের উপস্থিতি যে একেবারেই চোখে পড়েনি, তা নয়। তাদের চলার শৈল্পিক ভঙ্গির কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে নিপুণ ছন্দ। আছে নির্মল, নির্ভার জীবনের ছাপ। কারো কারো সখের কুকুর ছানাটিও হাঁটছিল মনিবের পায়ে পায়ে। আঁটোসাঁটো শীতবস্ত্র প্রাণীগুলোর গায়ে জড়ানো। তারপরও থেকে থেকে শীতল বাতাসে কেঁপে উঠছিল ওরাও।
আলোর শহর পারির আলো চোখ ধাঁধানো নয় মোটেই। বরং পাখির পালকের মতো নরম, তুলতুলে। শিশুর হাসির মতোই স্নিগ্ধ। আঁধো আলো, আঁধো ছায়ার মায়াবী, মুগ্ধতায় মোড়ানো এক রমনীয় নগরী। চলার পথে, ট্রেন, মেট্রো বা বাসস্টপে বুনো পায়রার মতো নরনারীর ওষ্ঠে চুম্বনে অবাক হওয়ার কিছু নেই এখানে। তবে তা দেখে দাঁড়িয়ে পড়া পেরিয়ে যায় ভদ্রতার সীমা।
সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, আধুনিক শপিংমল, হোটেল-রেস্তোঁরা, পানশালা কিংবা বোয়াত দ্য নুই (নাইটক্লাব), কোথাও নেই চকমকে আলোর ঝলকানি। তবে নোয়েলের (ক্রিসমাস) কারণে কিছুটা বাড়তি আলোকসজ্জা চোখে পড়ে পারিতে। পারিজিয়ানদের গমনাগমনে এইসব মিলনমেলা হয় মুখোরিত। তবে হিমাগম কিছুটা হলেও ভাটা টেনেছে এই উপস্থিতিতে।
রোববার রাতটি এখানকার মানুষের কাছে বেশ অপেক্ষার প্রহর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে পানশালার চৌহদ্দিগুলোতে ঘন হয়ে আসে মানুষের উপস্থিতিও। কর্মব্যস্ত মানুষের কাছে শনি ও রবিবার আয়েশ করে একটু বাড়তি ঘুমের দিনও। ফরাসিরা বলেন, গ্রাসমাটিনে। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই শয্যাত্যাগের তাড়া নেই। বরং যতটা সময় বিছানায় লম্বা হয়ে থাকা যায়।
পারির রেস্তোঁরাগুলো কেবল ভোজনশালাই নয়, সৌহার্দ্য, বন্ধুবৎসল সংস্কৃতির প্রাচীন প্রতিষ্ঠানও বটে। টেখাস বলে খ্যাত রেস্তোঁরার উঠোনে মুখোমুখি বসিবার আয়োজন, পথঘেঁষে, কিছুটা বেমানান লাগলেও এটাই এ দেশের যুগযুগান্তরের সংস্কৃতি। কাফে আলোঞ্জে কিংবা কাফে ক্রেমের মঁ মঁ সুবাস, অথবা হলদে আলোয় রেডওয়াইন, বিয়ারের চকচকে পেটমোটা গ্লাসে যেভাবে সন্ধ্যা নামে, পৃথিবীর অন্য শহরগুলোয় হয়তো তা বিরল। খাবারের কত যে রকমফের! কতটা বৈচিত্র্য যে হতে পারে রসনাবিলাস, তা ফরাসিদের না দেখলে অনুমান করা অসম্ভবই। গাসথ্রোনমির বিশাল এই সম্ভার পাতখিমোয়ান বা ঐতিহ্যের অংশ। শতশত বছর ধরে এই ঐহিত্য লালন করে আসছেন আদি গলুয়ার উত্তরসুরীরা।
ফরাসিদের আড্ডার বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে যেমন অজস্র বই লেখা হয়েছে, তেমনি সিনেমা নাটকেও আছে তার উপস্থিতি। শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, সিনেমা-নাটক, দর্শন, জীবনযাপনের বৈচিত্র্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার, খেলাধুলা একটু-আধটু রাজনীতির প্রসঙ্গও উঠে আসে সরস আড্ডায়। ফরাসিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই আড্ডা অন্যতম।
নভেম্বরের শুরু থেকেই নোয়েলের (ক্রিসমাস) প্রস্তুতি শুরু হয় ফরাসি দেশে। সেই ধারাবাহিকতায় পারিতে লেগেছে উৎসবের রঙ। রঙিন আলোয় সাজানো হয়েছে দোকানপাট, অভিজাত শপিংমলগুলো। প্রিয়জনদের জন্য উপহার কেনা। এ লক্ষ্যে বিপণী বিতানগুলোও সেজেছে নতুন ঢঙে। পেখ নয়েল বা সান্তা ক্লজের নিখুঁত অবয়ব নিঃশব্দে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কোথাও কোথাও। আছে সাপা বা আলোকসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রিও। সন্তর্পণে উৎসবের এই আমেজ বয়ে বেড়াচ্ছে পারিসিয়ানদের নিত্যকার যাপনে। নোয়েলের আনন্দ ভাগাভাগিতে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। সাধ্যের মধ্যে সবাই যেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন, সে জন্য ব্ল্যাক ফ্রাইডে তো আছেই। এই অপেক্ষাতেও দিন গুনছেন কেউ কেউ।
একদিকে জেঁকে বসা শীত। অন্যদিকে উৎসবের প্রস্তুতি। হিম নগরজীবনের বাহ্যিক উষ্ণতা কেড়ে নিলেও উৎসবের আমেজ তাপ ছড়াচ্ছে ফরাসিদের যাপিতজীবনে।
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক
mhfahad71@gmail.com