মো. ইলিয়াস
১৩ অক্টোবর ২০২২, ১০:৫৫ পিএম
সরকার হটানোর আন্দোলনের ‘খুঁটি’ গেড়ে রাজনীতির মাঠে অনড় বিএনপি। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় ১৬টি সমাবেশের মধ্যে দিয়ে প্রথম দফার আন্দোলন শেষে বিরোধী দলটি বর্তমানে বিভাগীয় কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত। এরই অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে সমাবেশও করেছে তারা। যার মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হচ্ছেন। এর জ্বলন্ত উদাহরণ চট্টগ্রামের সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ ছাড়াও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে দেশের নয় বিভাগেই এমন সমাবেশ ঘোষণা করছে বিএনপি। যা চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের সমাবেশের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এছাড়া কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ‘মহাসমাবেশও’ করবে দলটি। তবে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামের সমাবেশে নেতাকর্মীদের অনেক উজ্জীবিত দেখা গেছে।
যদিও বিএনপি নেতাদের অভিযোগ- চট্টগ্রামের সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে হামলা করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে নেতাকর্মীদের বাসায় ও হোটেলগুলোতেও পুলিশের তল্লাশি করা হয়েছে। তারা আরও অভিযোগ করেছেনে- চট্টগ্রামের পটিয়ার ইন্দ্রোপুল, গিরিশ চৌধুরী বাজার এলাকার বাইপাস সড়ক ও নতুন ব্রিজ এলাকায় পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে দক্ষিণের বিভিন্ন উপজেলা থেকে যানবাহনে করে সমাবেশে আসার পথে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নামিয়ে দিয়েছে পুলিশ।
তবে এতেও বুধবার নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসা থেকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাই বিষয়টিকে পজিটিভভাবেই দেখছেন বিএনপি নেতারা।
তারা বলছেন- পুলিশ জায়গায় জায়গায় বাধা না দিলে আরও বেশি লোকের সমাগম হতো। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসছে এবং সামনে আরও আসবে। যেহেতু জনগণ পথে নেমেছে, পুলিশের বাধা না থাকলে আরও নামবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৮২টি সাংগঠনিক জেলা ও এর অধীনের ইউনিটে এসব সমাবেশ সফল করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ১০টি শক্তিশালী টিম। যেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি, সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকসহ জেলার নেতাদের রাখা হয়েছে।
আরও জানা গেছে, জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি সংবলিত ৩০ লাখ লিফলেট ও পোস্টার তৈরি করে ইতোমধ্যেই সারাদেশে পাঠিয়েছে বিএনপি। ‘একদলীয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান’ শিরোনামে ওই লিফলেট ও পোস্টারে পুলিশের গুলিতে নিহত নুরে আলম, আব্দুর রহিম, শাওন প্রধান, শহিদুল ইসলাম শাওন ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে নিহত আব্দুল আলমের ছবিও রাখা হয়েছে।
গত ২২ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিএনপির ইস্যুভিত্তিক এই আন্দোলন বিভাগীয় পর্যায়ের গণসমাবেশের কর্মসূচিতে রূপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের পর ধারাবাহিকভাবে আগামী ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় এবং ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ করবে দলটি। সবশেষ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে।
এরই মধ্যে সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে গত ১ থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত এসব বিভাগের সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছাড়াও ৮২ সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ দুই নেতাকে নিয়ে গুলশান কার্যালয়ে মতবিনিময় সভাও করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। ওই সময় লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি সভায় অংশও নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সবমিলিয়ে সব সমাবেশে সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতি চেয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
এ জন্য ইতোমধ্যে নানা দিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে জেলা ও মহানগরে কোনো কোন্দল থাকলে তা সমাধানের ওপর জোর দিতে বলেছে হাইকমান্ড। ওই সভার পর সব সাংগঠনিক জেলার নেতারা নিজ এলাকায় ইতোমধ্যে চলে গেছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে টিমগুলোও বিভাগে প্রস্তুতি সভাও করছে। জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ সংশ্লিষ্ট থানা, উপজেলা, পৌর ও ওয়ার্ডের কর্মীদের নিয়ে সভাও শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের নয় বিভাগে সমাবেশ বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্র থেকে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য দলের নেতাকর্মীদের উঠান বৈঠক ছাড়াও কর্মীসভা ও মতবিনিময় সভা আয়োজনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তৃণমূল বিএনপিকে আরও সংগঠিত করতে, তাদের চাঙ্গা রাখতে জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদেরও বলা হয়েছে। এতে সমাবেশ সফলে দলের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে সমন্বয়ও হচ্ছে।
অন্যদিকে, উঠান বৈঠকের মতো নির্দেশনায় সাধারণ মানুষের সঙ্গেও তাদের সংযোগ ঘটবে বলে মনে করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের পরবর্তী কর্মসূচি পালিত হবে ময়মনসিংহে। এ বিষয়ে কথা হলে ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকা মেইলকে বলেন, ময়মনসিংহ বিভাগের জেলা সমাবেশের জন্য আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ততা আমরা লক্ষ্য করছি। নেতাকর্মীদের মধ্যে যেরকম রয়েছে, সাধারণ জনগণের মধ্যেও ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, গতকাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড করছে। এতে আমরা বাধা ও হামলার আশঙ্কা করছি। তারা আগামীকালকে একটি সমাবেশ ডেকেছে, এছাড়া শুনতে পেরেছি ১৫ অক্টোবরও সমাবেশ দেবে। এমনকি বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জেলা থেকে ময়মনসিংহের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও শুনতে পেরেছি। আবার কোনো কোনো স্থানে পরিবহন নেতাদের ডেকে পরিবহন বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
তবে কোনো বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না উল্লেখ করে ইমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, যেমন স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করছি, জনগণের ঢল নামবে। নেতাকর্মীদের প্রতি আমাদের নির্দেশনা রয়েছে- সকল বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশে উপস্থিত থাকতে হবে। হামলা-বাধা দিয়ে নেতাকর্মীদের কিছুতেই থামাতে পারবে না। যেটা আমরা চট্টগ্রামের লক্ষ্য করেছি। ইনশাআল্লাহ, ময়মনসিংহেও পারবে না।
এদিকে, চট্টগ্রামের সমাবেশের বিষয়ে কথা হলে বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্যসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ঢাকা মেইলকে বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় থাকার সকল নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে। নৈতিকভাবে এরা আর ক্ষমতায় থাকতে পারে না। এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের উচিত এখনই পদত্যাগ করা।
আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, পদত্যাগের আগে আওয়ামী লীগের উচিত হবে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন হবে- সেটার জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমরা মিডিয়া সেলের মাধ্যমে প্রতিটি প্রোগ্রাম তথ্য যাদের সামনে তুলে ধরছি। আমার বিশ্বাস, খুব দ্রুতই এ সরকার বিদায় নেবে। এর কোনো বিকল্প নেই এবং তাই করা উচিত।
সার্বিক বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, চট্টগ্রামের সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম হয়েছে। পুলিশ জায়গায় জায়গায় বাধা না দিলে আরও বেশি লোকের সমাগম হতো। জনগণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে সবসময় রয়েছে। গত নির্বাচনে দিনের বেলা ভোট হলে আওয়ামী লীগ কোনো ভোটই পেত না, সে জন্য রাতের বেলা ডাকাতি করেছে- এটা নতুন কিছু নয়।
হঠাৎ করেই আমাদের সমাবেশে লোক বেড়ে যাচ্ছে বিষয়টি এমন নয় উল্লেখ করে বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, পুলিশ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভূমিকা নিচ্ছে, এটা না হলে এর থেকেও বড় বড় সমাবেশ হবে। আমরা জনগণের দাবি নিয়ে নেমেছি, তাই জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে আসছে এবং আরও আসবে। যেহেতু জনগণ পথে নেমেছে, পুলিশের বাধা না থাকলে আরও নামবে।
এমই/আইএইচ