images

রাজনীতি

নজিরবিহীন ভালোবাসায় দেশনেত্রীর বীরোচিত বিদায়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩০ পিএম

  • জানাজায় লাখো মানুষের চোখের জল ও শ্রদ্ধা
  • পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামীর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত খালেদা জিয়া
  • দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ
  • এত মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা আগে দেখেনি কেউ

লাখো মানুষের চোখের জল, দোয়া আর নীরব ভালোবাসার মধ্য দিয়ে শেষ হলো আপসহীন নেত্রীখ্যাত বেগম খালেদা জিয়া যুগের অবসান। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জানাজা শেষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর‌্যাদায় তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে।গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে এসে দীর্ঘ ত্যাগ-সংগ্রামের মধ্যে তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্মান অর্জন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, শেষ বিদায়ে তার বর্হিপ্রকাশ ঘটালো জনসমুদ্র। জানাজা শেষে চারপাশে ছিল শুধু নীরবতা, সেই নীরবতার ভেতর যেন লুকিয়ে ছিল একটি জাতির গভীর শ্রদ্ধা।

শেষ বিদায় জানাতে আসা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভাষ্য, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যে শূণ্যতার তৈরি হলো তা অপূরণীয়। তবে তিনি মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন কর্মে প্রেরণায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন নন, ছিলেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য নাম। রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থেকেও যিনি আপস করেননি নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে, যিনি বারবার বাঁধা-বিপত্তির মধ্যেও দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন নির্ভীকভাবে।বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বার্থ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন।যে কারণে দেড়যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও তার জনপ্রিয়তায় কোনো কমতি হয়নি, বরং বহুগুনে বেড়েছে।

1

বুধবার (৩১ডিসেম্বর) বেলা ৩টার দিকে জাতীয় সংসদ জানাজায় যেমন মানুষের ঢল নেমেছিল, দাফনের সময়ও ঠিক তেমনই ভারী হয়ে উঠেছিল জিয়া উদ্যানের পরিবেশ। রাষ্ট্রীয় মার‌্যাদায় দাফন সম্পন্ন করার সুবিধার্থে উদ্যানের আশপাশের সড়কে ছিল কড়া নিরাপত্তা। যে কারণে নির্ধারিত লোক ছাড়া কারও দাফনের সময় সেখানে প্রবেশের সুযোগ ছিল না।

গত মঙ্গলবার সকাল ৬ টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যৌথ সভায় খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফনে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

জানাজায় অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া চলে গেলেও তিনি রেখে গেছেন এক অনন্য উত্তরাধিকার। সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মমর্যাদার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। জীবিত খালেদা জিয়ার চেয়েও প্রয়াত খালেদা জিয়া যে শক্তিশালী তা কর্মের মাধ্যমে তারা বাঁচিয়ে রাখবেন।

রাজধানীর শ্যামপুর থেকে জানাজায় অংশ নিতে আসা বিএনপি কর্মী শহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের জানাজার সময় শাহবাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর‌্যন্ত আসতে পেরেছিলাম। কিন্তু আজকের জানাজা দেখে মনে হয়েছে পুরো শহরটা জানাজায় পরিণত হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় বেগম খালেদা জিয়াকে মানুষ কি পরিমাণ ভালোবাসে। আমরা তার আদর্শ রক্ষা করতে চাই।’

সংসদ এলাকার জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের সড়কে

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় সংসদ সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জানাজা শেষে শেরে বাংলা নগরে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে সমাহিত হন খালেদা জিয়া। বেলা ২ টা জানাজার সময় নির্ধারিত থাকলেও তা সম্পন্ন হয় বিকেল ৩ টার পরে। খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বুধবার ভোর থেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও এর আশেপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকে মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে দিন শেষে বিএনপির চেয়ারপারসনের শেষ বিদায়ের এই অনুষ্ঠান সর্বজনীন এক জমায়েতে পরিণত হয়। রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকা ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসে মানুষ। প্রবল আবেগ আর ভালোবাসাকে সঙ্গী করে আসা মানুষগুলোর চোখে ছিল জল।

2

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংসদ ভবন সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে তৈরি করা হয় জানাজা মঞ্চ। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনের তিনটি মাঠের অধিকাংশ জায়গা জুড়েই মানুষ অবস্থান নেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বিজয়সরণীতে দাঁড়িয়ে মানুষ জানাজায় অংশ নেন। অন্যদিকে ধানমণ্ডি ২৭, ধানমণ্ডি ৩২ ছাড়িয়ে রাসেল স্কয়ারের দিকেও অবস্থান নেয় মানুষ। ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার এলাকায়ও মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে।

দুরে থেকেও নিজ নিজ উদ্যোগে অন্য কোন খোলা জায়গায়, বাসা-বাড়ির ছাদে জমায়েত হয়ে খালেদা জিয়ার জানাজায় শামিল হয়েছেন। এমনকি মেট্রোরেলের স্টেশনে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের জানাজায় সামিল হয়েছেন অনেকে।

এদিকে দলের চেয়ারপারসনের শেষ বিদায়ে উপস্থিত থাকতে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীতে আসতে শুরু করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। বুধবার ভোর থেকেই খালেদা জিয়ার জানাজাস্থলে আসতে শুরু করে মানুষ। তারা প্রথমে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার সামনের মাঠগুলোতে অবস্থান নেন। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ছাড়িয়ে যায়। বেলা ১২ টার দিকে খালেদা জিয়ার মরদেহ আনা হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়। জানাজা স্থলে আসা মানুষের সহায়তার জন্য মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের অনেক স্থানে জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়। মাইকে পরিবেশন করা হয় কোরআন তেলাওয়াত। এছাড়া খালেদা জিয়ার জীবনীর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রও কিছুক্ষণ পর পর দেখানো হয়।

তবে মাইকের শব্দ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় জানাজায় আসা মানুষকে।

3

দুপুরের দিকে জানাজাস্থলে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের উপদেষ্টা, তিনবাহিনী প্রধানসহ দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। দুপুর আড়াইটার দিকে জানাজাস্থলে আসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর কিছুক্ষণ পরে আসেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এসময় প্রধান উপদেষ্টা তাকে সান্ত্বনা দেন।  প্রধান উপদেষ্টার পাশেই দাঁড়ান তারেক রহমান।

দুপুর আড়াইটার পরে সংসদ ভবন এলাকা থেকে খালেদা জিয়ার মরদেহবাহী গাড়ি জানাজাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেয়। মানুষের ভিড় ঠেলে কয়েকশ মিটারের পথ আসতে ২০ মিনিটের বেশি সময় লেগে যায়। ২ টা ৫০ মিনিটের পরে জানাজাস্থলের কাছে পৌঁছায় গাড়ীটি। পরে খালেদা জিয়ার কফিন এনে রাখা হয় মঞ্চে। জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত আলোচনায় খালেদা জিয়ার জীবনী নিয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন তারেক রহমান

জানাজার আগে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সবার কাছে দোয়া চান তার বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।জানাজায় অংশ নিতে আসা বিপুল মানুষের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘দোয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা যাতে ওনাকে (খালেদা জিয়া) বেহেশত দান করেন।’

5

তারেক রহমান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে যদি কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে তাঁরা যেন তাঁর (তারেক রহমান) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন। আর বেগম খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে তার কোনো ব্যবহারে, কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।

বিকেল তিনটার পরে শুরু হয় জানাজার আনুষ্ঠানিকতা। জানাজা ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। বিকেল ৩ টা ৫ মিনিটের দিকে জানাজা শেষে খালেদা জিয়ার মরদেহ কাঁধে করে নিয়ে রাখা হয় গাড়িতে। এসময় গাড়ির চারপাশে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরে দলের নেতাদের নিয়ে বাসে ওঠেন তারেক রহমান। পরে লেক রোড দিয়ে জিয়া উদ্যানে পৌঁছায়।

স্বামীর পাশে শায়িত হলেন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়

জানাজা শেষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেই জিয়া উদ্যানে স্বামীর পাশেই শায়িত হন বেগম খালেদা জিয়া।১৯৮১ সালের ২ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা হয়েছিল। পরে তাকে সমাহিত করা হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে, যার বর্তমান নাম জিয়া উদ্যান।

জানাজা শেষে সংসদ ভবনের সামনে থেকে কড়া নিরাপত্তায় পতাকা শোভিত লাশবাহী গাড়িতে করে খালেদা জিয়ার কফিন জিয়া উদ্যানের সামনে নেওয়া হয়। এরপর সেতুর কাছ থেকে কফিন কাঁধে নিয়ে যান সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। কফিনের ঠিক পেছনে ছিলেন তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা। বিকেল সাড়ে ৪টায় তারেক রহমান কবরে নেমে মাকে সমাহিত করেন।

এরপর রাষ্ট্রপতির তরফে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কবরে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আদিল। তারপর প্রধান উপদেষ্টার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ তারিক পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল শ্রদ্ধা জানান। তারপরে শ্রদ্ধা জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এরপরে শ্রদ্ধা জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। তারপর সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে।

দাফন অনুষ্ঠানে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জায়মা রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি, মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, জুবাইদার বোন শাহিনা জামানসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

7

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মাহবুব উদ্দিন খোকন ছিলেন।শেষে প্রয়াতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

মোনাজাতের পর তারেক রহমানের কাছে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও তিন বাহিনী প্রধানরা সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।

শ্রদ্ধা জানালেন বিদেশি অতিথিরা

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাবিক, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি এন ধুঙ্গেল, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির উচ্চ শিক্ষা, শ্রম ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী আলি হায়দার আহমেদ, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাথ।

তারা তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান। চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের প্রধানরাও তাদের দেশের পক্ষে খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে মানিক মিয়া অ্যাভেনিউয়ে শেষ যাত্রায় অংশ নেন।

জানাজায় প্রধান উপদেষ্টাসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদরা

খালেদা জিয়ার জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বাম পাশে দাঁড়ান তারেক রহমান, তারপরে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং তারপরে দাঁড়ান নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার।

আর সরকারপ্রধানের ডান পাশে দাঁড়ান প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, তারপরে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এবং তারপরে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন।

প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি তার সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ফাওজুল কবির খান, আ ফ ম খালিদ হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, সি আর আবরার, এম সাখাওয়াত হোসেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকও ছিলেন জানাজায়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতারকর্মীরা জানাজায় শরিক হোন। জানাজায় দেখা গেছে কবি ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারকে।

রাজনীতিকদের মধ্যে জামায়াত ইসলামীর শামীম সাঈদী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরকে দেখা গেছে। ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের শায়খ আহমাদুল্লাহ, মিজানুর রহমান আজহারী, আল্লামা মামুনুল হক প্রমুখ বিএনপি নেত্রীর জানাজায় অংশ নেন।

এক নজরে খালেদা জিয়া জীবন-সংগ্রাম

মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, ‘আপসহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়া। তার মৃত্যুতে দেশে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে, বুধবার ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধা পাওয়া খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪১ বছর। তিনি পাঁচবারের সংসদ সদস্য, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী; আর বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার।

জানাজার আগে বেগম খালেদা জিয়ার জীবন-সংগ্রাম ও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের ইতিহাস তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। শৈশব থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। পরবর্তী জীবনেও তিনি এ অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক চর্চায়। তাই তার রাজনীতিও ছিল নিজের মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত। ফুলের প্রতি অনুরাগের কারণেই হয়তো সবচেয়ে কঠিন সময়েও তার সকল রাজনৈতিক বক্তব্য থাকত সুশোভিত।

তিনি বলেন, ১৯৬০ সালের ৫ অগাস্ট তৎকালীন সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা, ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই পুত্রের মাঝে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এবং কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে প্রকৃতপক্ষে বিনা চিকিৎসায় ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার লাশ যখন ঢাকায় আসে, তখন তার মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ছিলেন তার গুলশান অফিসে, সেই একই সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্তরীণ।

খালেদার রাজনীতিতে নামার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নজরুল ইসলাম খান বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন ছিল আকস্মিক, কিন্তু দেশের প্রয়োজনে তা ছিল অনিবার্য। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপদগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম শাহাদাতবরণ করার পর দলের দলীয় সরকারের ভিতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে, সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এবং সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে।

সেই সময় দল এবং দলীয় নেতাদের ‘মনোবল অটুট রাখার লক্ষ্যে’ ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করে খালেদার রাজনীতিতে নামার কথা তুলে ধরেন দলের স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

তিনি বলেন, শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের ক্লান্তিহীন পথচলা। ক্রমশ দলের প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী হয়েও দলের গঠনতন্ত্র সমুন্নত রেখেও তিনি দলের ভাইস চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন, তারপর দলীয় কাউন্সিলে নির্বাচিত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছরই তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলকে সুসংহত করেছেন, শক্তিশালী করেছেন।

বিইউ/টিআই/এআর