বোরহান উদ্দিন
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৬ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য সব ঝুঁকি মাথায় রেখে আগাম কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপি। বয়স্ক, অসুস্থতা, ঋণখেলাপি জটিলতা কিংবা মনোনয়ন যাচাইয়ে বাতিল হওয়ার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে দলটি অনেক আসনে মূল প্রার্থীর পাশাপাশি ব্যাকআপ বা বিকল্প প্রার্থী প্রস্তুত রেখেছে। যারা সবাই মনোনয়নও জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ একাধিক নেতা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন, যা নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিএনপির জন্য নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।
ঢাকা বাদে ৬৩ জেলায় জমা পড়া মনোনয়নপত্রের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১৮টি আসনে প্রায় ১৭৯ জন বিএনপি নেতা ধানের শীষ প্রতীকের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে মনোনয়নপত্র দিয়েছেন। যাদের মধ্যে বিকল্প ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন।
এদিকে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করার পরও একাধিক মিত্র দলের নেতার বিপরীতে বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা মাঠে থাকলে শরিকদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হওয়ার শঙ্কা আছে।
গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে অনেক আসনে প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ধানের শীষের প্রার্থীর পাশাপাশি বিকল্প প্রার্থীকেও মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। মনোনয়নের চিঠিতে সংযুক্তি–১ উল্লেখ থাকলে তিনি প্রাথমিক চূড়ান্ত প্রার্থী এবং সংযুক্তি–২ উল্লেখ থাকলে তিনি বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
কোনো কারণে প্রাথমিক প্রার্থী মনোনয়ন যাচাই–বাছাইয়ে অযোগ্য ঘোষিত হলে সংশ্লিষ্ট আসনে বিকল্প প্রার্থীকে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জানানো হবে। এছাড়া দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনে সরে দাঁড়াতে বিকল্প প্রার্থীদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে একাধিক আসনে মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনি কৌশলের অংশ হিসেবে শেষ দিকে অন্তত ১৮টি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে বিএনপি। মাঠপর্যায়ের জরিপ, দলীয় অসন্তোষ ও স্থানীয় রাজনৈতিক সমীকরণ বিশ্লেষণ করেই ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়ও সর্বোচ্চ তিনটি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। খালেদা জিয়ার তিনটি আসনেই বিকল্প প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ফেনী-১ (ফুলগাজী-পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন ওই আসনে খালেদা জিয়ার নির্বাচন সমন্বয়ক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম (মজনু)। খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলে তিনি বিএনপির প্রার্থী হবেন-এমনটা আগেই জানানো হয়েছিল।
বগুড়া-৭ (গাবতলী) আসনে খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম এবং দিনাজপুর-৩ (সদর) আসনেও খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী হিসেবে সাবেক পৌর মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
এদিকে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পাশাপাশি তার ছেলে ড. খন্দকার মারুফ হোসেনকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে। ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ) আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পাশাপাশি ডামি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা রেজাউল করিম পল।
বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন পান দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী রফিক। তার ঋণখেলাপিসংক্রান্ত জটিলতা থাকায় বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকিরকে। বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তার ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওই আসনে বিএনপির নেতা মীর শাহে আলমকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার মনোনয়নের চিঠিতে সংযুক্তি-২ লেখা রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনে সাবেক সচিব মুশফিকুর রহমানকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। ৯০ বছর বয়সী মুশফিকুর রহমান বয়সের ভারের কারণে একা চলাফেরা করতে পারেন না। সে কারণে ওই আসনে কবির আহমেদ ভূঁইয়াকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার মনোনয়নের চিঠিতে সংযুক্তি-২ লেখা রয়েছে।
সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা-মধ্যনগর-তাহিরপুর-জামালগঞ্জ) আসনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক আনিসুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি বিকল্প প্রার্থী হিসেবে জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুলকে মনোনয়নের চিঠি দেয় বিএনপি। তার মনোনয়নের চিঠিতেও সংযুক্তি-২ লেখা রয়েছে।

সুনামগঞ্জ-২ আসনে (দিরাই ও শাল্লা) বিএনপির মনোনয়ন পান দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. নাছির চৌধুরী। বর্ষীয়ান এই নেতা অসুস্থতার কারণে একা চলাফেরা করতে পারেন না। সেজন্য ওই আসনে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক তাহির রায়হান চৌধুরী (পাভেল)কে মনোনয়ন দেওয়া হয়। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে নাছির চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে তাহির রায়হান চৌধুরীও ছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় তাহির নিজে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে পরদিন মনোনয়ন জমা দেন।
আরও পড়ুন
বড় দলে ‘হারিয়ে যাচ্ছে’ ছোটরা
মুন্সিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও একমি গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সিনহাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ থাকায় বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়। তিনিও মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির বেশ কিছু নেতা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছেন তারা। তবে বিএনপির হাইকমান্ড জানিয়েছেন, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে কেউ ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে শিগগিরই বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হবে।
বিএনপির যেসব নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তারা হলেন-
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ ও বিজয়নগরের একাংশ) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা, ঢাকা-১২ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরব, ঢাকা-১৪ এস এ সিদ্দিক সাজু, পটুয়াখালী-৩ হাসান মামুন, ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ-সদর আংশিক) আসনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, কুড়িগ্রাম ৩ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) আব্দুল খালেক, চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক এমএ হান্নান, চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) আসনের বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নূরুল হুদার ছেলে, জেলা বিএনপি নেতা তানভীর হুদা, সুনামগঞ্জ-৪ (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন, বরিশাল-৩ (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) আসনে মুলাদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবদুস সাত্তার খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে সাবেক এমপি কাজী আনোয়ারের পুত্র কাজী তাপস, ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে করিম সরকার, ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে বিএনপি নেতা মামুন বিন আবদুল মান্নান। এছাড়াও আরও বেশ কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি নেতারা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রধান প্রার্থী যেকোনো কারণে মাঠে থাকতে না পারলে বিকল্প প্রার্থীকে আমরা সঠিক সময়ে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবো। এটি আমাদের নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ, যাতে ধানের শীষের শক্তি অটুট থাকে এবং ভোটে কোনো ঝুঁকি না থাকে।’
সাবেক একজন ছাত্রদলের শীর্ষ নেতা যিনি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তার কাছে জানতে চাইলে প্রতিক্রিয়ায় তিনি নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘১৭ বছরের ত্যাগ ও সংগ্রামের পরও আমাদের মনোনয়ন হয়নি। এখন নেতাকর্মীদের সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামছি। আশা করি, দলের জন্য বিজয় এনে দিতে পারব, এমনকি দলের নির্দেশনা না পেলেও।’ দল বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত নিলেও নির্বাচন থেকে সরবেন না বলেও জানান তিনি।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, আল্লাহর পরিকল্পনা মানুষের বোঝার বাইরে। আল্লাহর এ পরিকল্পনায় আমার বাবা (অলি আহাদ) ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের জোয়ারের বিপক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছিলেন। রাব্বুল আলামিনের কী অদ্ভুত পরিকল্পনা। ২০২৬ সালে এসে ধানের শীষের জোয়ারের বিপক্ষে আমাকে স্বতন্ত্র লড়াই করতে হচ্ছে। আল্লাহর পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা মানুষের বোঝার বাইরে।
বিইউ/জেবি