images

রাজনীতি

১৭ বছরের দূরত্ব ঘুচল নয়াপল্টনে, আবেগাপ্লুত নেতারা

বোরহান উদ্দিন

৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৩৮ এএম

  • নেতাকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস, জেল-জুলুমের কষ্ট উধাও
  • ভার্চুয়াল নেতৃত্ব থেকে সরাসরি সান্নিধ্য
  • ব্যস্ততার মাঝেও নিলেন খোঁজ, দিলেন দেশ গড়ার বার্তা

দীর্ঘ ১৭ বছর প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থেকেছেন আট হাজার কিলোমিটার দূরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সেখান থেকেই এতদিন দেশে থাকা নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করতেন।  

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেসব বৈঠক চললেও তারেক রহমানকে কাছ থেকে দেখা বা তার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ কারও ছিল না। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) তারেক রহমান দেশে ফিরলে নেতাকর্মীদের সেই অপেক্ষার অবসান হয়। সান্নিধ্য পান প্রিয় নেতার।

বহু বছর পর নেতাকর্মীরা কাছ থেকে দেখছেন তারেক রহমানকে। কারও সঙ্গে তিনি সালাম বিনিময় করছেন, তার সঙ্গে কেউ পাচ্ছেন ছবি তোলার সুযোগ। ব্যস্ত সময় কাটানো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফাঁকে ফাঁকে নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, দিচ্ছেন নানা দিক-নির্দেশনা, নিচ্ছেন পরিবারের খোঁজও।

তারেক রহমানের সাক্ষাত পাওয়া একাধিক নেতা জানালেন, দলের শীর্ষ নেতার এমন সান্নিধ্যে তারা উচ্ছ্বসিত। ব্যক্তিগত খোঁজখবর নেওয়ায় বিগত আন্দোলনকালে জেল-জুলুমের যে কষ্ট, তা যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেছে।

এসবের মাঝেই দেড়যুগ পর সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান তারেক রহমান। সেখানে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তাদের অনেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তোলা ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। পাশাপাশি কার্যালয়ের বাইরে ছিল হাজারো কর্মীর ঢল। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন পুরো নয়াপল্টন।

এদিন বিকেল চারটার দিকে এসে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো ব্যস্ত সময় কাটিয়ে কার্যালয় ছাড়েন তারেক রহমান। বিদায় বেলায়ও ছিল নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড়।

T2
নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পর তারেক রহমানকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বিএনপিরে শীর্ষ নেতারা। 

যা বলছেন উচ্ছ্বসিত নেতারা

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি শুরু করি, তখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। সে কারণে কখনো সরাসরি আমাদের দেখা হয়নি। ফোন, স্কাইপিতে বহুদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হলেও আজকে সরাসরি কাছ থেকে দেখা, সালাম বিনিময় ও ছাত্রদলের নেতারা কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। এটা সবার জন্য অত্যন্ত আনন্দের।’

তিনি বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। নির্বাচনে ছাত্রদল কীভাবে প্রচারণায় থাকবে, প্রার্থীদের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করবে- সেসব বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন। ক্যাম্পাসে নিয়মিত ছাত্রদের সংগঠনে যুক্ত করে ছাত্রদলকে আরও শক্তিশালী করতে বলেছেন। ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে হতাশ না হয়ে সামনের দিনে ঘুরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।’

ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘প্রিয় নেতা আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খোঁজও নিয়েছেন। যারা আন্দোলন করতে গিয়ে গুম-খুন, আহত হয়েছেন- সেসব পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া চেয়ারপারসনের অসুস্থতার কারণে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন সংক্ষেপ এবং সিম্পলভাবে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লা আমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা যারা এই প্রজন্মের ছাত্রদলের নেতাকর্মী, তাদের কাছে তারেক রহমান একটি অনুভূতির নাম। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে প্রজ্বলিত ছিলেন। এতদিন দূরে থেকে তার নির্দেশনায় আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, এখন সাক্ষাতে ওনার দেশগড়ার পরিকল্পনার অংশ হতে পারছি, এই অনুভূতি শব্দ দিয়ে লেখা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ সময়ের লড়াইয়ে অনেককে অনেক সময়ে ঝিমিয়ে পড়তে দেখেছি, অনেকে লড়াইয়ের একটা পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু আমরা ছাত্রদল লড়ে গিয়েছি। কারণ আমাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার একজন ছিলেন, তিনি তারেক রহমান। যিনি আমাদেরকে শেকল ভাঙ্গার মন্ত্র শিখিয়েছেন।’

স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি সত্যি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিগত সময়ে স্কাইপে, জুমে অসংখ্য মিটিং করেছি। একক মিটিংও হয়েছে। সেই মানুষকে সরাসরি দেখার মুহূর্ত সত্যি বলে বোঝানো যাবে না। এ অনুভূতি আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না। আমি তৃপ্ত। তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীর বাংলাদেশ, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ, আমরা সবাই মিলে তার প্রত্যাশা পূরণ করব।’

রামপুরা থানা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক নিলুফা ইয়াসমিন নিলু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আজ খুব আনন্দিত। জীবনের সেরা দিন। অন্যরকম একটা অনুভূতি। ১৭ বছর পর নেতার কাছে যাওয়া, কথা বলা, ছবি তোলার সুযোগ হয়েছে। সত্যি আমি ভাগ্যবান। আন্দোলনের সময় উত্তরায় মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হয়েছি, সেকথা বলতে পেরেছি প্রিয় নেতাকে। আজীবন এই মুহূর্তটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

T1
নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় তলায় উঠে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন তারেক রহমান।

১৭ বছর পর দেশে ফিরে এই প্রথম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এদিন বেলা ৩টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে রওনা হয়ে বিকেল ৪টায় নয়াপল্টনে পৌঁছান তারেক রহমান। এসময় দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতসহ কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান।

এসময় তারেক রহমান কার্যালয়ে ঢুকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এরপর নিজের জন্য নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে বসেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দোতলায় দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কক্ষের পাশেই তার জন্য চেম্বার তৈরি করা হয়েছে।

এসময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আবদুস সালাম, হাবিবুন্নবী খান সোহেল, কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, ডা. রফিকুল ইসলাম, আফরোজা আব্বাস, ডা. পারভেজ রেজা কাঁকন, আসাদুল করীম শাহীন, মনির হোসেন, রফিক শিকদার, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, মাহমুদুর রহমান সুমন, মুনায়েম মুন্না, হাবিবুর রশিদ হাবিব, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী, তারিকুল আলম তেনজিং, তানভীর আহমেদ রবিন, মো. নবীউল্লাহ নবী, ইয়াসিন আলী, রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আরও উপস্থিত ছিলেন- আবদুল লতিফ জনি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. একেএম শামছুল ইসলাম, আতিকুর রহমান রুমন, মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন মৃধা, অ্যাডভোকেট মেহেদুল ইসলাম মেহেদী, ডা. শাহ্ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ, ডা. আনম মনোয়ারুল কাদির বিটু, আব্দুর রহমান সানী, শায়রুল কবির খান ও জাহিদুল ইসলাম রনি প্রমুখ।

২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাগারে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয় তারেক রহমানের ওপর। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি সবগুলো মামলা থেকে জামিন পান। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। তৎকালীন সরকারের নানা ষড়যন্ত্রে আর ফিরতে পারেননি। তার বক্তব্য প্রচারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল বিগত সরকার।

অবশেষে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এবং বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হলে তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়। তিনি ফিরলেনও। ১৭ বছর পর তার এই প্রত্যাবর্তনকে মৃত গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম হিসেবে দেখছেন দলের নেতাকর্মীরা।   

বিইউ/এএইচ