মহিউদ্দিন রাব্বানি
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২১ পিএম
দীর্ঘ ১৭ বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতারা। তাদের মতে, দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফেরা শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়; বরং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ ফেরারি জীবন শেষে তারেক রহমানের দেশে ফেরার খবরে বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আনন্দ মিছিল, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অনেক নেতা-কর্মী মনে করছেন, তার প্রত্যাবর্তনে দল সাংগঠনিকভাবে আরও সুসংহত হবে এবং মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়তা বাড়বে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকার কারণে তারেক রহমান সরাসরি রাজনীতির মাঠে উপস্থিত ছিলেন না। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত ও কৌশলগত দিকনির্দেশনায় তার ভূমিকা ছিল। এখন দেশে ফিরে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় বিএনপির রাজনীতি আরও দৃশ্যমান ও গতিশীল হবে। একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র ও কার্যকর করে তুলতে পারে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ইতিবাচক।
২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারেক রহমানের আগমনকে অনেকেই ‘টাইমিংয়ের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ’ মনে করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, জোট রাজনীতি, প্রার্থী বাছাই এবং মাঠপর্যায়ের কৌশল নির্ধারণে তার সরাসরি উপস্থিতি বিএনপির জন্য বাড়তি সুবিধা তৈরি করতে পারে। এতে দলটি নির্বাচনী রাজনীতিতে আরও আত্মবিশ্বাসী ভূমিকা নিতে পারবে।
রাজনীতিবিদদের একাংশের মতে, দীর্ঘ ফেরারি জীবন থেকে দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াটা সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের জন্যও ইতিবাচক বার্তা বহন করে। এতে রাজনৈতিক সমঝোতা, সংলাপ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা মনে করেন, দেশের বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, প্রত্যাবর্তনের পর তার রাজনৈতিক ভূমিকা ও কৌশলই নির্ধারণ করবে এই ঘটনাটি কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা আশা প্রকাশ করেন, তারেক রহমান দেশের রাজনীতিতে সহনশীলতা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাবেন।
সব মিলিয়ে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে এই প্রত্যাবর্তন কীভাবে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলায়, সেদিকেই এখন নজর রাজনীতি বিশ্লেষক, দলীয় নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের।
বিগত ২০০৭ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার হন সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। নির্যাতনের মুখে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে ২০০৮ সালে কারামুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন এবং রাজনৈতিক অনুপস্থিতির পর দেশে ফিরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি'র এই শীর্ষ নেতার দেশে ফিরে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, তারেক রহমানের আগমনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা আরও বৃদ্ধি পাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার তুলনামূলক প্রতিযোগিতা বাড়বে। অনেকেই তার আগমনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
বরেণ্য রাজনীতিবিদের আগমনে স্বাগত জানিয়েছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি। দলটির আমির ডাক্তার শফিকুর রহমান বিদেশি একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, একজন রাজনৈতিক সহকর্মী দীর্ঘ ১৭ বছর পর সরাসরি রাজনীতির মাঠে ফিরছেন, এটিকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও ইতিবাচক হিসেবে দেখেন তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘটনাটিকে। তবে তিনি মনে করেন, তারেক রহমান কীভাবে ভূমিকা রাখবেন, তা জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান নির্ধারণ করবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেছেন, তারেক রহমানের আগমন দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। কারণ দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে বিএনপির মতো বৃহৎ একটি দল সরাসরি নেতৃত্ব বঞ্চিত ছিল। তারেক রহমানের আগমনে সেই শুন্যতা পূরণ হবে বলে আশা করা যায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বললেন, দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একজন বাংলাদেশি নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতার নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার পুনরুদ্ধার হওয়া গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের একটি ইতিবাচক প্রতিফলন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, দেশে যখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও নির্বাচন হবে কি না- এ নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান দেশে ফেরায় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দূর হলো।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে ফেসবুকে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পুত্র তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। তিনি লিখেছেন, ‘আবার স্বাগতম! বাংলাদেশ আপনার কাছ থেকে ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে। আমাদের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অতল গহ্বর থেকে বের করে আনার এবং ঐক্য ও নতুন আশা নিয়ে আসার জন্য আপনার জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ অপেক্ষা করছে। আমি আপনার জন্য শুভকামনা জানাই।’
এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলমও তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান প্রায় দেড় যুগ পর বাংলাদেশে ফিরছেন। স্বৈরাচারের পতন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি দেশে আসছেন।
জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক মিজানুর রহমান আজহারীও তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘সুদীর্ঘ ১৮ বছর পর জনাব তারেক রহমান স্বপরিবারে দেশে ফিরেছেন। প্রিয় জন্মভূমিতে আপনাকে সুস্বাগতম। দেশের কল্যাণে নিবেদিত হোক আপনার এই প্রত্যাবর্তন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স: ‘নির্বাচনের আগে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরেছেন শীর্ষ প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ নেতা’।
এএফপি: ‘নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৭ বছর পর দেশে ফিরলেন খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি’।
ফরাসি বার্তা সংস্থা: ‘বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা পরিবারের উত্তরসূরি এবং সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরছেন’।
বিবিসি: ‘বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ নেতা ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন’।
আনাদোলু এজেন্সি: ‘১৭ বছর নির্বাসিত থাকার পর দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী তারেক রহমান’।
আলজাজিরা: ‘বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন শাসক পরিবারের উত্তরাধিকারী এবং দেশের শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতা তারেক রহমান প্রায় ১৭ বছর নির্বাসনের পর দেশে ফিরেছেন’।
এনডিটিভি: ‘খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান বাংলাদেশে ফিরলেন: নির্বাসনের সময়টি যেমন ছিল’।
ইন্ডিয়া টুডে: ‘খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান দেশে ফিরেছেন। কেন এটি ভারতের জন্য ভালো খবর?’
আনন্দবাজার: ‘সপরিবার বাংলাদেশে ফিরলেন তারেক রহমান! ১৭ বছর পর খালেদা-পুত্রের প্রত্যাবর্তন আশা জোগাচ্ছে বিএনপিকে’।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এমআর