আব্দুল কাইয়ুম, বোরহান উদ্দিন
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০১ পিএম
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার খবর গত কয়েক দিন ধরে ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে অবশেষে দেশে ফিরলেন তিনি। এক সময় কারাগার থেকে হুইল চেয়ারে করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া এই রাজনীতিক বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) ফিরে এলেন লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস ও আবেগে ভেসে। তার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন ছিল অভূতপূর্ব। এর মধ্য দিয়ে তার ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটল।
২০০৭ সালের আলোচিত এক এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় ৭ মার্চ গ্রেফতার হন তারেক রহমান। পরে রিমান্ডে তাঁর ওপর চালানো হয় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় কারাবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান তারেক রহমান। প্রায় ১৮ মাস কারাভোগ শেষে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। এরপর কেটে যায় প্রায় দেড় যুগ। দেশের মাটিতে পা রাখার সুযোগ হয়নি, দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়নি। সেই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটল বৃহস্পতিবার।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তারেক রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও কন্যা জাইমা রহমান। শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু তারেক রহমানকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভিআইপি লাউঞ্জ এলাকায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাকে স্বাগত জানান। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘদিন পর দলের কান্ডারিকে সামনে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন অনেক নেতাকর্মী। বিমানবন্দর এলাকায় স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে চারদিক। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে সাধারণ নেতাকর্মীদের বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ ছিল না, তবু আশপাশের সড়কজুড়ে অবস্থান নেন তারা।
এসময় তারেক রহমান জুতা খুলে মাটিতে কিছু সময় হাঁটেন। মাটিও ছুঁয়ে দেখেন।
বিমানবন্দরে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান শেষে দুপুর ১২টা ৪১ মিনিটে তারেক রহমানের গাড়িবহর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের গণসংবর্ধনা মঞ্চের উদ্দেশে রওনা হয়। তবে শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই যাত্রা স্বাভাবিক হবে না।
বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে সকাল থেকেই অবস্থান নিয়েছিলেন লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক। কেউ এসেছেন দলীয় পতাকা হাতে, কেউ ফুল নিয়ে, কেউ বা ব্যানার-প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে পুরো এলাকা।
এই বিপুল জনসমাগমের কারণে ঢাকার উত্তর প্রান্তের যান চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দর থেকে তিনশ ফিটের সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
বেলা ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে তারেক রহমানের গাড়িবহর সংবর্ধনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছায়। তবে নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড ভিড়ে গাড়ি আর সামনে এগোনো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়ি থেকে নেমে ৩টা ৫০ মিনিটে লাল গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে সভামঞ্চে ওঠেন তিনি।
সেই মুহূর্তে পুরো এলাকা করতালি, স্লোগান ও আবেগে ফেটে পড়ে। চারদিক থেকে ফুলের তোড়া ছুটে আসে মঞ্চের দিকে। অনেক নেতাকর্মী আবেগ সামলাতে না পেরে কাঁদতে থাকেন।
ঘন কুয়াশার মধ্যে ভোর থেকে সংবর্ধনাস্থল ঘিরে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। অনেকে এক-দুই দিন আগে থেকে এই এলাকায় এসে অবস্থান নেন। সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে মঞ্চ ও আশপাশের এলাকা সাজানো হয় দলীয় পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুনে। অনেক নেতাকর্মীর পরনে ছিল দলীয় রঙের জার্সি, মাথায় ক্যাপ, কপালে ব্যান্ড। কেউ কেউ দলের লোগো সংবলিত ব্যাজ পরে এসেছেন। এমনকি অসুস্থ ও বয়স্ক নেতাকর্মীদেরও হুইল চেয়ারে করে আসতে দেখা যায়।
সকাল ১০টা থেকেই মঞ্চে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন।
তারেক রহমানের আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সংবর্ধনা কমিটির আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন আহমদ। তারা বলেন, এই প্রত্যাবর্তন শুধু একজন নেতার দেশে ফেরা নয়, এটি গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ শীর্ষ নেতারা। এ ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে সংবর্ধনা ঘিরে বিমানবন্দর ও ৩০০ ফিটসহ রাজধানীতে সতর্ক অবস্থায় ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিজিবি ও সেনাবাহিনীও ছিল সতর্কাবস্থায়। বিশেষ করে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় নয়টি চেকপোস্টসহ আশপাশে এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থায় চেকপোস্ট বসানো হয়। সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করেন র্যাব ও ডিএমপির গোয়েন্দারা।
নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে বিমানবন্দর, গুলশান ও এভারকেয়ার হাসপাতাল এলাকায় আগে থেকেই ড্রোন ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদিও তারেক রহমানে সংবর্ধনাস্থলে আসার সময় অনেক ড্রোন উড়তে দেখা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা ও সংবর্ধনাকে ঘিরে নিরাপত্তা পরিকল্পনায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সেখান থেকে ৩০০ ফিট সমাবেশ মঞ্চ, এরপর এভারকেয়ার হাসপাতাল হয়ে গুলশান পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা ও তার বাসভবন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরে সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তারেক রহমানকে সবাইকে নিয়ে নিরাপদ দেশ গড়ার কথা বলেছেন। নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘উই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্যা পিপল, ফর দ্যা কান্ট্রি। ইনশাল্লাহ, আমরা সেই প্ল্যান বাস্তবায়ন করব।’
জনগণের প্রত্যাশিত দেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, এখানে যারা আছেন, যারা নেই তাদের সবাই মিলে জনগণের প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। যেকোনো উসকানির মুখে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
সংবর্ধনা শেষে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার সান্নিধ্যে পৌঁছান তারেক রহমান। নেতাকর্মীদের তীব্র ভিড় ঠেলে তারেক রহমানকে বহনকারী বিশেষ বাস সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে এভারকেয়ারে পৌঁছায়।
এসময় হাসপাতালের আইসিইউ কেবিনে মায়ের শয্যাপাশে সময় কাটান তারেক রহমান। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। তার সঙ্গে স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান ছিলেন। মাকে দেখা শেষে তিনি পরিবারসহ গুলশানের বাসায় ফিরে যান।
এদিকে তারেক রহমানের দেশে ফেরা উপলক্ষে গণসংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর উত্তরপ্রান্তের সব সড়কে ছিল তীব্র যানজট। অনেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় দুর্ভোগে। অবশ্য এমন আয়োজনকে ঘিরে দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে বিএনপির পক্ষ থেকে আগে থেকেই দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল।
বিশেষ করে সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীরা যাওয়ার সময় অনেক সড়কে আটকে থাকে যানবাহন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যা বাড়তে থাকে। তবে বিকেলের দিকে তারেক রহমানের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হতে শুরু করে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সমর্থক ও বিরোধী সব পক্ষের রাজনীতিবিদরাই এই প্রত্যাবর্তনকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। কেউ একে দেখছেন গণতন্ত্রের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় হিসেবে, কেউ বলছেন এটি বিএনপির জন্য বড় রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের মুহূর্ত।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, একজন রাজনৈতিক সহকর্মী দীর্ঘ ১৭ বছর পর সরাসরি রাজনীতির মাঠে ফিরছেন, এটিকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঐক্যের ব্যাপারে তারেক রহমান কী ভূমিকা রাখেন অথবা কী পরিকল্পনা আছে তার এবং বাস্তবায়ন কীভাবে করবেন- এসব বিষয়ে জামায়াত নজর রাখবে।
এর আগে দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে জামায়াত আমির লিখেন, ‘জনাব তারেক রহমান, সপরিবারে সুস্বাগতম!’
এদিকে জামায়াতের সেক্রটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও বলেছেন, তিনিও ইতিবাচক হিসেবে দেখেন তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘটনাটিকে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে লিখেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একজন বাংলাদেশি নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতার নিজ ভূমিতে ফেরার এই অধিকারটি পুনরুদ্ধার হওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরই একটি ইতিবাচক প্রতিফলন।’
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনধারা নিয়ে তিনি লিখেন, ‘তারেক রহমান এবং তার পরিবার রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং তাকে দীর্ঘ সময় নির্বাসিত থাকতে হয়েছে। হাজারো শহীদের রক্তদানের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ফলে এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে যেখানে তিনি ও তার পরিবার দেশে ফিরে আসতে পেরেছেন।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, দেশে যখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও নির্বাচন হবে কি না- এ নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছিল, এমন প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান দেশে ফেরায় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দূর হলো।
এছাড়াও এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি মুহাম্মদ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও মহাসচিব; জমিয়তের উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও মহাসচিব পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন। সবাই তার এই প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে লিখেন, ‘ফিরে আসায় স্বাগতম। বাংলাদেশ আপনার কাছ থেকে ব্যতিক্রমী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে।’
রাজনীতিবিদদের বাইরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, তারকা জগতের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসহ অনেকেই তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে ফেসবুকে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বিইউ/একেএস/জেবি