images

রাজনীতি

হাসিনার আসনে এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিএনপি-জামায়াতের

নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার দল আওয়ামী লীগের। 

ফলে টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা হাসিনা এবং তার দল এবার থাকছে নির্বাচনের বাইরে। স্বাভাবিক ভাবেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যে আসনগুলো থেকে নির্বাচন করতেন, এবার সবগুলোই ফাঁকা। তারই একটি গোপালগঞ্জ-৩, যেখানে এবার প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।  

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না, ফলে গোপালগঞ্জ-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। টুঙ্গিপাড়া এবং কোটালিপাড়া উপজেলা নিয়ে এই আসন। শেখ হাসিনার পৈত্রিক বাড়ি সেখানে এবং তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিও সেখানে।

সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে গোপালগঞ্জ-৩ আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সবসময় নৌকা মার্কা বিজয়ী হয়েছে। অতীতে নৌকার বিপরীতে প্রার্থীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তাই টুঙ্গীপাড়া ঘুরে ভোটারদের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, একটা বড় অংশই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে ভোট দিতে যাবেন না- অনেক ভোটার এমন কথাও প্রকাশ্যে বলেছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ না থাকলেও তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটে অংশ নেবেন।

কী বলছেন স্থানীয় ভোটাররা?

টুঙ্গিপাড়ার গোপালপুর গ্রামের এক নারী ভোটার জানান, এখনো কেউ ভোট চাইতে তাদের কাছে যাননি। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময়কার পরিস্থিতির উপর ভোট দিতে যাবেন কি না, সেটি নির্ভর করছে। নিরিবিলি ভোট হোক, সুষ্ঠু ভাবে এটাই আমরা চাই।’

গোপালগঞ্জে নির্বাচনের প্রাথমিক প্রচার প্রচারণা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল আলোচনায় আছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া সক্রিয় আছে এনসিপি, প্রার্থী থাকতে পরে স্বতন্ত্র এবং জাতীয় পার্টি থেকেও।

ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং কী বার্তা দেয়- তার একটা বড় প্রভাব পড়তে পারে এই গোপালগঞ্জ এবং সারাদেশের নির্বাচনেই।

টুঙ্গিপাড়ার একজন চা দোকানদার খুরশিদ আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেউ দোষ করলে তাকে সাজা দিক। দল কেন নিষিদ্ধ হবে? আওয়ামী লীগ ভোটে না থাকলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।’

তফসিলের পর ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ কেমন- এ প্রশ্নে ওই দোকানির স্পষ্ট উত্তর, ‘আমরা তো টুঙ্গিপাড়াবাসী, আমাগের ভিতর কোনো আগ্রহ নাই। দল নাই দেশে, আপনি দল বাদ দিয়ে ইলেকশন করতিছেন, সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবি।’

টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি বাজারের একজন বলেন, ‘ভোট দিতে যাবো কীভাবে, আমার প্রার্থী যদি না থাকে মাঠে, তাহলে কি আমি ভোট দিতি যাবো?’

উপজেলার বাইরে গোপালপুর গ্রামের বাজারে মিহির কবিরাজ নামে একজন বলেন, ‘একদিক দিয়ে আমার ভালো লাগতিছে যে, সামনে ভোট আসতিছে, আমি আমার ভোটটা দিতি পারব। যাকে খুশি তাকে দেব।’

সঞ্জিত কুমার নামে একজন বলেন, ‘গোপালপুর ইউনিয়নের লোকজন গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদ পছন্দ করে না, ভোট হবি, ভোট দিতি যাবি।’

তবে অমিত মণ্ডল নামে আরেকজন বলেন, ‘এই নির্বাচনে ভোট দেবেন না অনেকেই। তার ভাষায়, ‘একতরফা নির্বাচন যারে কয়, আগে যা শেখ হাসিনা করছে, এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তারাও এইভাবে করবি।’

প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কোন কোন দল?

গোপালগঞ্জ-৩ আসনে এবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি প্রার্থী দিয়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে তাদের প্রার্থী থাকবে। সেইসঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীও প্রচার চালিয়েছেন। এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে ভোটের প্রচারণা করেছেন।

নির্বাচনে ওই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন দলের মধ্যে হবে, এ প্রশ্নে পাটগাতি বাজারে একজন ব্যবসায়ী আব্দুল হাফিজ দাবি করেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে ভালো আগ্রহ আছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি কিছু জায়গায় ভিন্ন, কোনো সমস্যা নাই। মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাবে এবং স্বতস্ফুর্তভাবে ভোট দেবে।’

ব্যবসায়ী আব্দুল হাফিজ আরও বলেন, ‘কেউ চাইলেই ভোট বানচাল করতে পারবে না।’ গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার সংসদীয় আসনে এবার কেমন প্রতিদ্বন্দিতা হবে- প্রশ্নে তার মত, ‘এ জাগা জামায়াত আর বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’

গোপালগঞ্জ এবং সারাদেশেই আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ও ভোটার রয়েছে। বড় দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে একটা শঙ্কা থাকে। তবে সেই পরিস্থিতি এবং ভোটের চিরাচরিত মিথ এবার পরিবর্তন হবে বলে মনে করছে জামায়াতে ইসলামী।

দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গোপালগঞ্জ নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছে গোপালগঞ্জেও আমরা জয়ী হবো।’

তিনি বলেন, ‘হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগ- এরকম একটা ধারণা ছিল। তারা যেমন বদলে দেবে, গোপালগঞ্জ মানেই আওয়ামী লীগ এরকম একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। দেশের কিছু জেলার ব্যাপারে ‘ও এই এরিয়া, ওতো আওয়ামী লীগ’- কিন্তু তা যে না হয়েও যেতে পারে, তারা ভোট দিয়ে সেটা প্রমাণ করে দেবে যে, আমরা মানে আওয়ামী লীগ নই, এমনও হইতে পারে।’

জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন

আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের দলটির কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু সারাদেশে আওয়ামী লীগের একটা ভোটব্যাংক আছে বলে মনে করা হয়। দলটি অতীতে সব নির্বাচনেই ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। দলের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের পুরনো জোটসঙ্গী এবং রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- নিষিদ্ধ না হলেও দলটি রাজনীতির মাঠে ব্যাপক কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। সেই সঙ্গে দলের মধ্যেও বিভক্তি আছে।

এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় পার্টি এবং জিএম কাদেরের নেতৃত্বে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জিএম কাদেরের মতে, আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন ঠিক হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন তো প্রশ্নবিদ্ধ থাকবেই। এটা যখন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করেছে, তখন আমি অনেকবার বলেছি। বারংবার আমি বলেছি। আমি মনে করি, এটা ঠিক হচ্ছে না। এখনো ঠিক হচ্ছে না।’

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্য্যান জিএম কাদের জানিয়েছেন, তার দলও হামলার শিকার হচ্ছে। তাদের পার্টি অফিসেও একাধিকবার হামলা হয়েছে। হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে তাকেও।

তিনি বলেন, ‘এখন যদি আমরাও মাঠে গিয়ে ঠিকমতো নির্বাচনটা না করতে পারি, তাহলে বিশ্ব দরবারে এ নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। যেহেতু পরিবেশ খুবই খারাপ, অনেকেই এখনই অনেক ব্যাপারে উৎকন্ঠিত- বিদেশিরা বিশেষ করে।’

রাজনীতির এ বাস্তবতায় জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে দাবি করেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হলো- এটা জাতীয় পার্টিকে দেখে মানুষ জাজ করবে। জাতীয় পার্টিকে সমান সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কি না। লেভেল প্লেইং ফিল্ড হচ্ছে কি না- বিশ্ববাসী এটা দেখতে চাইবে। এই দলটাকে (জাতীয় পার্টি) ব্যান করার কোনো কারণ নাই। তারা যতই চেষ্টা করুক।’

এদিকে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় বড় দল হিসেবে বিএনপির জয়ের একটা বড় সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগ না থাকলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।

কিন্তু নির্বাচনটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন ওঠা বা একতরফা নির্বাচন হবে কি না- এ প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তিনি তেমনটি মনে করেন না।

টুকু বলেন, ‘ইনক্লুসিভ ইলেকশন বলতে বোঝায় ইনক্লুসিভ ভোটার। টার্ন আউট অব দ্য ভোটার। এখন যদি সেভেনটি পার্সেন্ট ভোটার এই ইলেকশনে এসে ভোট দেয়, তাহলে কীভাবে বলবেন যে ভোট হয়নি?’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ডিনায়ালে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ অন্যায় করেছে। সাজাও হচ্ছে। আরও সাজা হবে। সুতরাং আওয়ামী লীগ নাই, এটা নিয়ে আমাদের তর্ক করার কিছু নাই।’

এদিকে বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করবে বলেও জানাচ্ছে।

তফসিল অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোট হলেও সেটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না- এমন দাবিও করছে আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করে, এ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারও টেকসই হবে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা

এএইচ