images

রাজনীতি

কবে ফিরবেন তারেক রহমান, কী জানা যাচ্ছে?

বোরহান উদ্দিন

০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৩ পিএম

মায়ের চিকিৎসায় অগ্রাধিকার তারেক রহমানের
খালেদার সুস্থতায় সহায়ক হতে পারে তারেকের ফেরা
অবস্থা দেখে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন: ফখরুল
সরকারের আশ্বাস ইতিবাচক দেখছে বিএনপি

দেশের রাজনীতির ভেতরে-বাইরে আলোচনায় জিয়া পরিবার। একদিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অন্যদিকে ১৭ বছর ধরে নির্বাসিত থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের দেশে ফেরার আলোচনা। এখনো দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে জানানো না হলেও শিগগির তিনি দেশের মাটিতে পা রাখবেন- সেই আভাস মিলেছে। ইতোমধ্যে তাঁর দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আইনি বাধাসহ যেসব সমস্যা ছিল তা অনেকটা কেটে গেছে।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে থাকা তারেক রহমানের দেশে ফেরার আলোচনা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ছিল। তবে এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের অসুস্থতার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তারেক রহমানের কাছে। বিশেষ করে গত ২৩ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসায় দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানকে নিয়ে সমন্বয় করছেন খোদ তারেক রহমান। দেশের চিকিৎসকরাও বিষয়টি বারবার বলছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের দ্রুত দেশে ফেরার চেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করায় তিনি বেশি জোর দিচ্ছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্র মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা অনেকটা সময়ের অপেক্ষা। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটের তফসিল ঘোষণার আগেই তাঁর দেশে ফেরার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কৌশলগত কারণে সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ করা হচ্ছে না।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মায়ের এমন সংকটের সময়ও তারেক রহমান কেন দেশে ফিরছেন না তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চললেও এই মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরলেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সমন্বয়ে বিঘ্ন ঘটবে। অন্যদিকে লন্ডন–ঢাকা সফরে লম্বা সময় বিমানযাত্রায় একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি সহজ করতে পারে।

T1
চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বহুদিন পর সাক্ষাৎ হয় তারেক রহমানের।  

অন্যদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোরও আলোচনা আছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তাঁকে বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি মেডিকেল বোর্ড। সিঙ্গাপুর, চীনের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে যে হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়েছিল সেখানেও নেওয়ার প্রস্তুতি আছে বলে জানা গেছে।

শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের যুক্তরাজ্যে থাকাবস্থায় খালেদা জিয়াকে সেখানে নেওয়ার সুযোগ হলে তা দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘চেয়ারপারসনকে বিদেশে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন।’

গুজবের ফাঁদে নেতাকর্মীরাও

এদিকে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবনতির খবর প্রকাশের পর থেকে তারেক রহমান যেকোনো সময় দেশে ফিরছেন সেই গুঞ্জন জোরালো হতে শুরু করে। সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদেরও এমন ‘গুজব’ প্রচার করছেন। যদিও বিএনপির দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ফেরা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানানো হয়নি।

সবশেষ মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পরিবারসহ তারেক রহমানের একটি পুরোনো ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে অনেকে তিনি দেশে ফিরছেন—এমন তথ্য প্রচার করেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কেউ আবার সেই ভিডিও প্রচারও করছেন।

খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে তারেক রহমান বাংলাদেশে আসতে পারেন।’

১৭ বছর ধরে দেশের বাইরে তারেক রহমান

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেফতার হয়ে ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তারেক রহমান। গ্রেফতারের পর তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয় বিএনপির তরফ থেকে। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ছাড়েন তারেক রহমান। দীর্ঘ সময় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।

পরবর্তী সময়ে বিএনপির তরফে জানানো হয়, ২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন। এক বছরের মধ্যেই তা গৃহীত হয়।

আওয়ামী লীগ আমলে একাধিক ‘মিথ্যা মামলা’র কারণে তিনি দেশে আসতে পারেননি-এমনটা বারবার বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘সহসাই দেশে ফিরবেন’ এমনটা বলা হলেও এতদিনেও তিনি না আসার কারণে প্রশ্ন উঠেছে।

হাসিনার পতনের পর তারেক রহমান নিজেও একাধিক বক্তব্যে দেশে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিএনপি নেতারা ‘শিগগিরই’, ‘যথাসময়ে ফিরবেন’-এমন বক্তব্য রাখছেন প্রতিনিয়ত।

তবে সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে তারেক রহমানের একটি পোস্ট নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে রাজনীতির ভেতরে-বাইরে। মায়ের অসুস্থতার মধ্যেও দেশে ফেরার বিষয়ে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ বলে জানান তারেক রহমান।

এরপরই প্রশ্ন উঠেছে-কেন তিনি বারবার বলেও দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না? দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তাঁর ঝুঁকি আছে কি না-সেই বিষয়ও আলোচনা হচ্ছে।

আপত্তি নেই, সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস সরকারের

চারিদিকে যখন তারেক রহমানের এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনা তখন সরকারের তরফ থেকে কোনো আপত্তি তো নয়, বরং তিনি দেশে ফিরতে চাইলে ট্রাভেল পাসসহ সার্বিক সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে।

তারেক রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে (তারেক রহমানের ফেরা) সরকারের তরফ থেকে কোনো বিধিনিষেধ বা কোনো ধরনের আপত্তি নাই।’

একই মন্তব্য করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘তারেক রহমানের দেশে আসায় আইনি বাধা আছে বলে আমার জানা নেই। নিরাপত্তায়ও সরকার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।’

তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘তারেক রহমান দেশে আসতে চাইলে কোনো বিধিনিষেধ নেই, এক দিনে ট্রাভেল পাস দেওয়া সম্ভব।’ মঙ্গলবার তিনি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তারেক রহমান ট্রাভেল পাস চাননি।

এদিকে সরকারের এমন অবস্থান তারেক রহমানের ফেরার পথ আরও উন্মুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনা ও অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি জানা যায়। ফলে মামলা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে তারেক রহমানের দেশে ফিরতে দৃশ্যত কোনো বাধা নেই বলে বলা হচ্ছিল। তবে তারেক রহমানের ফেরার বিষয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের আপত্তির বিষয়টি কাজ করে থাকতে পারে বলে বিএনপির ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।

T2
নিজে গাড়ি চালিয়ে মা খালেদা জিয়াকে লন্ডনের বাসায় নিয়ে যান তারেক রহমান।

ভিভিআইপি প্রটোকলে খালেদা জিয়া, সুবিধা পেতে পারে পরিবারও

অন্যদিকে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (ভিভিআইপি) ঘোষণা করে সরকার। এতে করে তাঁর নিরাপত্তা এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) দেবে। প্রয়োজনে তাঁর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাও এসএসএফ সুরক্ষা পাবেন বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার এভারকেয়ার হাসপাতালে এসএসএফ সদস্যরা দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সরকার বিশেষ নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সচিবালয়ে তিনি বলেছেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তায় যা যা দরকার, সরকার তা দিতে প্রস্তুত আছে। প্রয়োজনে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’

প্রস্তুত গুলশানের বাড়ি

গত জুন মাসের শুরুর দিকে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান দেশে কয়েক দিন থেকে লন্ডনে চলে যান। এরপর থেকেই আলোচনায় ছিল সহসাই দেশে আসবেন তারেক রহমান। তাঁর জন্য গুলশানে বাড়ি ঠিক করার কথাও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়।

গুলশান-২ এভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বরের বাড়িটি অন্তর্র্বতী সরকারের সময় নামজারি শেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে কাগজপত্রও তুলে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে ১৯৮১ সালে তৎকালীন সরকার দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ডুপ্লেক্স বাড়ি বরাদ্দ দেয়। এতদিন বাড়িটির নামজারি করা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারেক রহমানের জন্য বাড়ির ভেতর–বাইরেও সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে কাঁটাতারের বেষ্টনি, বাড়তি সিসিটিভি স্থাপন, চেকপোস্ট বসানো, অভ্যন্তরে আধুনিক সুবিধাযুক্ত সাজসজ্জা করা হয়েছে। দেশে ফিরলে তিন বেডরুম, ড্রয়িং, লিভিং রুম, সুইমিংপুলসহ সব সুবিধাসম্পন্ন বাড়িতে থাকবেন তারেক রহমান।

চেয়ারপারসনের অসুস্থতা, তারেক রহমানের দেশে ফেরাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সবার আগে চেয়ারপারসনের সুস্থতা। শুধু বিএনপি নয়, পুরো দেশবাসী তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন। দূরে থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চিকিৎসার সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। দূরে থাকলেও তিনি মায়ের পাশেই তো আছেন। আশা করি তাঁকে আমরা দ্রুতই কাছে পাবো।’

বিইউ/জেবি