বোরহান উদ্দিন
২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:০১ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মিত্রদের বেশ কিছু আসন ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তবে ৬৩ আসন ফাঁকা রেখে নিজ দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হলেও এখনো শরিকদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি দলটি। এতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর দিন কাটছে অপেক্ষায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় জোর দিতে পারছেন না প্রচার-প্রচারণায়। ফলে শরিকদের ভেতরে ক্ষোভ, হতাশা ও অস্বস্তি বাড়ছে।
শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ নিয়ে দফায় দফায় বিএনপির দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠক করেও সমাধান পাননি তারা। বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানানো হয়েছে।
সমমনা দলগুলোর কিছু নেতার অভিযোগ, বিএনপির হাইকমান্ড বিভিন্ন সময় শরিকদের কয়েকটি আসন ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের সময়ও বাকি আসনগুলো শরিকদের জন্য বিবেচনায় রাখার কথা বলেছিল। অনেককে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হলেও চূড়ান্ত ঘোষণা না আসায় তারা নির্বাচনি মাঠে দ্বিধায় আছেন।
লক্ষ্মীপুর–১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী এলডিপির (একাংশ) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর বেশ কিছুদিন পার হলেও শরিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না আসা হতাশাজনক। এতে আমাদের প্রস্তুতি ব্যাহত হচ্ছে, প্রতিপক্ষেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।'
শরিকদের ক্ষোভের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কাজ চলছে। শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানা যাবে। আগের মতো অনেক আসন ছাড় দেওয়া এবার সম্ভব নাও হতে পারে। তবে শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।’
৩ নভেম্বর বিএনপির প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকে সমমনা ১২ দলের নেতারা নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার দিন গুনছেন। বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি ইতোমধ্যে শরিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেও সমাধান চূড়ান্ত হয়নি।
এদিকে দুই জোটের শীর্ষ নেতাদের অন্তত ১২টি আসনে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার কথা জানা গেলেও কোনোটিই এখনো ঘোষণা হয়নি।
এসব আসনের মধ্যে রয়েছে: পিরোজপুর–১: মোস্তফা জামাল হায়দার (জাতীয় পার্টি–জাফর), বগুড়া–২: মাহমুদুর রহমান মান্না (নাগরিক ঐক্য), ঢাকা–১৭: আন্দালিব রহমান পার্থ (বিজেপি), লক্ষ্মীপুর–১: শাহাদাত হোসেন সেলিম (এলডিপি), কিশোরগঞ্জ–৫: সৈয়দ এহসানুল হুদা (বিজেডি), ঢাকা–১৩: ববি হাজ্জাজ (এনডিএম), ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৬: জোনায়েদ সাকি (গণসংহতি আন্দোলন), চট্টগ্রাম–১৪: অধ্যাপক ওমর ফারুক (এলডিপি), কুমিল্লা–৭: ড. রেদোয়ান আহমেদ (এলডিপি), নড়াইল–২: ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ (এনপিপি), পটুয়াখালী–৩: নুরুল হক নুর (গণঅধিকার পরিষদ), ঝিনাইদহ–২: রাশেদ খান (গণঅধিকার পরিষদ)।
এর বাইরেও বিএনপি জোটের সাবেক শরিকদের মধ্যও কোনো কোনো দল প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে।
তবে যে ১২ আসনের বিষয় অনানুষ্ঠানিকভাবে শরিকদের প্রার্থী করার কথা শোনা যাচ্ছে, এর অনেক জায়গায় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও জনসংযোগ শুরু করেছেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমার আসনে ইতিবাচক বার্তা মিললেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। বিএনপির লোকজন মাঠে, জামায়াতও কাজ করছে। আমরা অনিশ্চয়তায় ভুগছি। এভাবে হলে তো জোট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
আরও পড়ুন
বিএনপিতে ‘সৌভাগ্যবান’ ২৪ পরিবার
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুর রহমান শামীম ও লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে চূড়ান্ত মনোনীত করেছে বলে জানান। তারা রামগঞ্জ বিএনপি নেতাদের এই বার্তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েও দেন। কিন্তু আজকে কতদিন হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসেনি। বিএনপিকে বুঝতে হবে প্রতিপক্ষ কিন্তু দিনরাত মাঠ চষে বেড়াচ্ছে।'
প্রার্থিতা নিয়ে জটিলতার অবসানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা জানান এলডিপি নেতা সেলিম। এ বিষয়ে শরিক নেতাদের সঙ্গে তারেক রহমান কথা বলবেন বলে বিএনপির তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
ঢাকা–১২ আসনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হককে মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা থাকলেও সেখানে আগে থেকেই বিএনপির সাইফুল আলম নীরবকে সম্ভাব্য প্রার্থী করা হয়েছে। আবার সাইফুল হক মূলত ঢাকা–৮ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
২০১৮ সালে বিএনপির প্রতীক নিয়ে ঢাকা–১৮ থেকে নির্বাচন করা জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এবার ফেনী–৩ আশা করলেও সেখানে আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে প্রার্থী করেছে বিএনপি।
জেএসডি সভাপতি আ স ম রবের স্ত্রী তানিয়া রবের জন্য লক্ষ্মীপুর–৪ খালি রেখেছে বিএনপি, যদিও সেখানে দলটির সাবেক এমপি নিজান প্রকাশ্যে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন।
গণসংহতির জোনায়েদ সাকি জানান, তার আসন নিয়ে আশ্বাস থাকলেও অন্যান্য শরিকদের বিষয়ে অগ্রগতি নেই।
শরিকদের অনেকের মতে, বিএনপি কোনো আসন ছাড় দিলে জামায়াতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝুঁকি আসবে। অন্যদিকে সবাইকে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, যা ছোট দলগুলোর জন্য আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নুরুল হক নুর ও রাশেদ খান তাদের নিজ নিজ এলাকায় প্রচারণায় সক্রিয়। একইভাবে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানও পিরোজপুর ও ঝালকাঠি এলাকায় জনসংযোগ করছেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ তার।
মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঝালকাঠি-১ আসনে বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক দল ও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে সংসদ নির্বাচনে আমি একজন প্রার্থী। নির্বাচনে আমার প্রার্থিতা ও অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল লাগামহীনভাবে মিথ্যাচার করছেন। শুধু মিথ্যা, মনগড়া বক্তব্যই নয়, তার সমর্থকদের লেলিয়ে দিয়ে আমার ব্যানার পোস্টার ও ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলছে। আমার কর্মী সমর্থকদের হুমকি ধমকি প্রদান করে নির্বাচনি প্রচারণা বাধাগ্রস্ত করছে এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করছে। চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা হলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।’
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সমমনা ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের আসন ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে গত সেপ্টেম্বরে চাহিদাপত্র চেয়েছিল বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ১২ দলীয় জোট বিএনপির কাছে একটি তালিকা দিয়েছে। এতে আগামী নির্বাচনে ১৮টি আসনে ছাড় চেয়েছে ১২ দলীয় জোট। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটও বিএনপির কাছে প্রার্থী তালিকা দিয়েছে, আটটি আসন চেয়েছে এই জোট।
কিন্তু প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে আরপিও। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধিত মিত্র দলগুলোর প্রার্থীদের শেষ পর্যন্ত নিজেদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হলে অনেকেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। জাতীয়ভাবে পরিচিত নেতারা কেউ কেউ বিএনপির সহযোগিতায় দলীয় প্রতীকে জয়ী হয়ে আসতে পারলেও বাকিরা সুবিধা করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে নিবন্ধিত মিত্র দলগুলোকে আগের তুলনায় এবার কম আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি।
বিইউ/জেবি