images

রাজনীতি

বিএনপির সঙ্গে বিএনপির ‘লড়াই’

বোরহান উদ্দিন

১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৫ এএম

# প্রার্থিতা নিয়ে বিভিন্ন জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-অবরোধ
# অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে, তৃণমূলে ক্ষোভ
# কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের আভাস
# ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে বঞ্চিতরা আরও মরিয়া: বিশ্লেষক

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির প্রার্থী তালিকাকে কেন্দ্র করে দলে বিভেদ দেখা দিয়েছে। প্রকাশ্যে এসেছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। তৃণমূলেও ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে। কোথাও মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা সরাসরি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, কোথাও তাদের সমর্থকরা সড়ক-রেল অবরোধ, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগ করছেন। কয়েকটি আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে ‘আল্টিমেটাম’ও দেওয়া হয়েছে হাইকমান্ডকে।

গত ৩ নভেম্বর বিএনপি গুলশানে ২৩৭টি আসনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। প্রতিবাদের মুখে পরে একটি আসনের প্রার্থিতা স্থগিতও করা হয়।

ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, জয়পুরহাট, মাদারীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ হয়েছে। তৃণমূলের দাবি, ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে। দ্রুতই বেশ কয়েকটি আসনে পরিবর্তন দরকার।

5
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দলীয় নেতারা।

দলীয় সূত্র বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্র ঘোষিত প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রার্থিতা তালিকা ঘোষণার সময়ই বলা হয়েছে এটি প্রাথমিক তালিকা। কোথাও বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দিলে দল অবশ্যই বিবেচনায় নেবে।’

বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ, সংঘর্ষ

গত ৭ নভেম্বর বিকেলে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে সাবেক এমপি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম ও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শামসুদ্দিন মিয়া ঝুনুপন্থীদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মনোনয়ন বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়; ঘণ্টাব্যাপী চলে ভাঙচুর। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও বিক্ষুব্ধদের বাধায় ফিরে যেতে হয়।

৬ নভেম্বর জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে বিএনপির সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা ও মনোনীত প্রার্থী আব্দুল বারীর সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় দুইজন আহত হন।

N
নওগাঁয় বিএনপি প্রার্থী ডা. ইকরামুল বারী টিপুর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করা হয়। 

নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত এম এ মতিনের সমর্থকরা সড়ক অবরোধ করে মনোনীত প্রার্থী ডা. ইকরামুল বারী টিপুর মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর অনুসারীরা দল মনোনীত প্রার্থী ফারজানা শারমিন পুতুলের বিরুদ্ধে রেল অবরোধ করেন এবং পরে বড় সমাবেশ করে টিপুকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি তোলেন।

মাদারীপুর-১ (শিবচর) মনোনয়ন স্থগিত থাকার পরও ক্ষোভ থামেনি। গত ৩ নভেম্বর রাতে সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাবলুর সমর্থকেরা ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। এই আসনে প্রথমে প্রার্থী ঘোষণা ও পরে স্থগিত করায় ক্ষুব্ধ শিবচর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কামাল জামান মোল্লা নিজেও। শেষ পর্যন্ত তাকেই মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত এম এ হান্নানের সমর্থকরা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন।

H
চাঁদপুরে-৪ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত এম এ হান্নানের সমর্থকরা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন।

সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-কালিগঞ্জ) আসনে ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত ডা. শহিদুল আলম মনোনয়ন না পাওয়ায় তার সমর্থকেরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও ফুলবাড়িয়ায় ঘোষিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক বিক্ষোভ হয়। ৯ নভেম্বর গৌরীপুরে ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন ও আহমেদ তায়েবুর রহমান হিরণপন্থীদের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় মঞ্চ ও দোকানপাট।

কুমিল্লা-১০ (নাঙ্গলকোট-লালমাই) আসনে মনোনয়ন না পাওয়া মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেন।

কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত সামিরা আজিম দোলার গণসংযোগে হামলায় আহত হন ২০ জন। পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের হস্তক্ষেপে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আবুল কালামকে সমর্থন করার ঘোষণা দেন দোলা।

কুমিল্লা-৬ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিনকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তার সমর্থকরা টানা ১০ দিন ধরে কর্মসূচি পালন করছেন। ছাত্রদল নেতা রবিন খান বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

Yasin
কুমিল্লা-৬ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিনকে মনোনয়ন না দেওয়ায় মশাল মিছিল করে তার সমর্থরা।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মনোনয়ন না পাওয়ায় লায়ন আসলাম চৌধুরী–র অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাঁচ জায়গায় অবরোধ করেন। পরে যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। আসলাম চৌধুরী এখনো আশা করছেন শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাবেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আসনে প্রার্থী হিসেবে ৯০ বছর বয়সী সাবেক সচিব মুশফিকুর রহমানের নাম ঘোষণা দেওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে কঠোর সমালোচনা করে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি করছেন।

অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ মনোনীত প্রার্থী আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে সাবেক এমপি মিজানুর রহমান সিনহা এবং যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদপন্থীদের সংঘর্ষে অনেকে আহত হন।

ফেনী-২ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সদস্যসচিব ও মনোনয়নপ্রত্যাশী আলাল উদ্দিন আলালের ‘রিভিউ আবেদন’ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।

B
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে মনোনীত প্রার্থী আবদুল মান্নানের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. শামছুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কিছুটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তবে অতীতের মতো শুধু মনোনয়ন পেলেই যে জয়ী হওয়া যাবে—এমন পরিস্থিতি নেই। নির্বাচন কঠিন হবে। দলটির শীর্ষ নেতারাও এমন কথা বলছেন।

তফসিল পর্যন্ত যে সময় আছে, তাই বেশি সমস্যাগ্রস্ত আসনগুলোতে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলে দলের জন্যই ভালো হবে বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। একই দিন চারটি প্রশ্নে গণভোটও হবে। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের শুরুতে ভোটের তফসিল ঘোষণা করতে পারে।

বিইউ/এমআর