বোরহান উদ্দিন
০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৯ পিএম
• দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বে ভরসা
• ‘এক পরিবার, এক প্রার্থী’ নীতি
• রাজনীতিতে রক্তের উত্তরাধিকার
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩৭টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। এবার দলটি এক পরিবার থেকে একাধিক প্রার্থী না দেওয়ার নীতিতে অটল থেকেও ২৪টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছে এমন ব্যক্তিদের, যাদের বাবা ছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী কিংবা তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা। রাজনীতির দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে এদের অনেকেই এর আগে দলীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, কেউ কেউ আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। বিএনপির মতে, দলের ‘অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা’ করতেই এই সিদ্ধান্ত।
দলের নেতৃত্ব মনে করছে, নতুন প্রজন্মের এ রাজনীতিকরা পুরোনো নেতাদের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের উদ্যম দুটোরই সমন্বয় ঘটাতে পারবেন। আর মনোনয়ন পাওয়া অনেকেই বলেছেন, দলের এই আস্থার জবাব তারা মাঠে কাজের মাধ্যমেই দিতে চান।
পঞ্চগড়–১: সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকারের জায়গায় তার ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে ধানের শীষের টিকিট দিয়েছে বিএনপি। সাবেক ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জমিরউদ্দিন সরকার এখনও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। তার ছেলে নওশাদ জমির বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নাটোর–১: সাবেক যুব ও ক্রীড়া এবং সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পুতুল নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলেন।
কুষ্টিয়া–২: সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ চৌধুরীর ছেলে রাগীব রউফ চৌধুরীকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাগীব রউফ সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্যানেল আইনজীবী হিসেবেও পরিচিত।
জয়পুরহাট–১: সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মোজাহার আলী প্রধানের ছেলে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধানকে প্রার্থী করেছে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি জয়পুরহাটে সংগঠন ও আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
যশোর–৩: সাবেক তথ্য এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে একই আসনে প্রার্থী ছিলেন।
ঝিনাইদহ–৩: এই আসনে প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মেহেদী হাসান, যিনি ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম মাস্টারের ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয়।
পিরোজপুর–২: এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আহমেদ সোহেল মঞ্জু সুমন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের ছেলে। পিরোজপুর বিএনপির রাজনীতিতে তার পরিবার বহুদিন ধরে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে।
মৌলভীবাজার–৩: সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের রহমানকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি নাসের রহমান ২০০১ সালের উপনির্বাচনে ওই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি দলীয় রাজনীতিতে সংস্কারপন্থী ধারারও একজন পরিচিত মুখ।
ঢাকা–৪: সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানভীর আহমেদ রবিনকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামাচ্ছে বিএনপি। রবিন বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব। তার বাবা পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন।
ঢাকা মেইলকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তানভীর আহমেদ রবিন বলেন, বাবা এই আসনের একাধিকবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। বাবার কাছ থেকে মানুষের জন্য কিভাবে কাজ করতে হয়, মানুষের পাশে থাকতে হয় শিখেছি। দল এবার যে দায়িত্ব দিয়েছে বাবার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা নিয়ে বিজয়ী হবো ইনশাল্লাহ।
ঢাকা–৬: অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে তিনি ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে পৌনে দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে। তবে শপথ না পড়ানোয় তিনি মেয়রের চেয়ারে বসতে পারেননি। আন্দোলনের পর নিজেই শপথ নিয়ে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে বেশ আলোচনার জন্ম দেন।
ফরিদপুর–২: বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদকে এই আসনে প্রার্থী করেছে দলটি। তিনি বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি একই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন।
ফরিদপুর–৩: সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে চৌধুরী নায়াব ইউসুফকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
মানিকগঞ্জ–২: ধানের শীষের টিকিট পেয়েছেন মঈনুল ইসলাম খান, সাবেক শিল্পমন্ত্রী শামসুল ইসলাম খানের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং একসময় মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মানিকগঞ্জ–৩: এই আসনে বিএনপির প্রার্থী আফরোজা খানম রিতা, তিনি প্রয়াত সংসদ সদস্য হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে। বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রাম–৫: বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের বাবা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন দলের ভাইস চেয়ারম্যান। মীর হেলাল বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
চট্টগ্রাম–৭: বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে এই আসনে প্রার্থী করেছে দলটি। তিনি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং অতীতে একাধিকবার কারাভোগ করেছেন।
চট্টগ্রাম–১৪: সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে বিএনপি। বাপ্পা বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক।
গাজীপুর–২: ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র আব্দুল মান্নানের ছেলে মঞ্জুরুল করিম রনি। স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় রনি তার বাবার মতোই উন্নয়নমুখী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন।
গাজীপুর–৪: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আ স ম হান্নান শাহ’র ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজকে প্রার্থী করছে বিএনপি। ২০১৮ সালেও তিনি এই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন।
রিয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবারে আমার বড় হওয়া। ২০১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর থেকে রাজপথে ছিলাম, কারাবরণ করেছি, সংগঠনকে সক্রিয় রেখেছি। দল সেসব বিবেচনায় নিয়েই আমার ওপর আস্থা এই আসনটি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উপহার দিতে চাই।’
ময়মনসিংহ–৯: উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আনওয়ারুল হোসেন খান চৌধুরীর ছেলে ইয়াসের খান চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। তিনি নান্দাইল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক।
শেরপুর-১: আসনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর মেয়ে সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা, ৩২ বছর বয়সী একজন চিকিৎসক। তিনি তখন বিএনপির সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী ছিলেন এবং বর্তমানে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক।
শেরপুর–২: আসনে সাবেক হুইপ প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ফাহিম চৌধুরী, তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
শেরপুর–৩: আসনে সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল হকের ছেলে মাহমুদুল হক রুবেল প্রার্থী হয়েছেন। তিনি ২০০১ সালের নবম সংসদের সদস্য ছিলেন এবং বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
সিলেট–১: সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত খন্দকার আবদুল মালেকের ছেলে ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মোক্তাদির চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদেরও ধীরে ধীরে দায়িত্ব নিতে হবে। আগামীদিনে তরুণরা নেতৃত্ব দেবেন। দল যাদের যোগ্য মনে করেছে তাদের বেছে নিয়েছে। আশা করি তারা ভালো করবেন।’
বিইউ/ক.ম