images

রাজনীতি

জাতীয় পার্টি কি নিষিদ্ধ হচ্ছে?

বোরহান উদ্দিন

০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯ এএম

• জামায়াত-এনসিপিসহ বেশিরভাগ দলের একই সুর
• আ.লীগের মতো একই কারণে জাপাকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
• জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের আইনগত দিক যাচাই বাছাই হচ্ছে: অ্যাটর্নি জেনারেল
• নিষিদ্ধের দাবিতে আমরা ভীত নেই: জাপা মহাসচিব

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর এবার দাবি উঠছে জাতীয় পার্টি নিয়ে। দলটির নিবন্ধন বাতিল, নির্বাচনে অযোগ্য করার দাবি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদনের পর এবার রাজপথেও জাপার কার্যক্রম নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠেছে। সবশেষ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও জামায়াত-এনসিপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে সঙ্গী হয়ে থাকা দলটির নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে- ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাহলে কি জাতীয় পার্টিও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ছে?

এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো বক্তব্য না আসলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে জাতীয় পার্টি কেন নিষিদ্ধ হবে না সেই প্রশ্নও রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সব বিতর্কিত নির্বাচন ও জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগের দমন পীড়নে সহযোগিতা করেছে জাতীয় পার্টি। এ কারণে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে এর আইনগত দিক যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’

তার এমন বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে- ভোটারবিহীন, বিতর্কিত নির্বাচনে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির একই পরিণতি হচ্ছে?

বিশেষ করে গত শুক্রবার গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার পর জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে চাপ বাড়ছে। সভা-সমাবেশে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লেবার পার্টিসহ আরও অনেকে এই দাবি করছেন। তাদের অভিযোগ, স্বৈরাচার খেতাব পাওয়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও জাতীয় পার্টি কার্যক্রম চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা জেলে, মামলার আসামি হলেও জাপা নেতারা নির্বিঘ্নে দিন পার করছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে তারাও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আরও পড়তে পারেন

ফের চাপে জাপা, জোরালো হচ্ছে নিষিদ্ধের দাবি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত ১৫-১৬ বছরে জাতীয় পার্টি সরকারের কাছাকাছি থেকে যে সুবিধা নিয়েছে গত বছরের আগস্টের পটপরিবর্তনের পরও তারা নির্বিঘ্নেই দিন পার করছেন। এমন অবস্থায় জুলাই আন্দোলনের শরিক, রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাদের নিষিদ্ধের দাবি উঠা স্বাভাবিক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের হাতে যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে তার দায় জাতীয় পার্টিরও আছে। কারণ পুরো সময়ে তাদের সঙ্গে তারা ছিলো। নানা সুবিধাও নিয়েছে। সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে, এখন জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের ক্ষোভ তো থাকা স্বাভাবিক।’

জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হকও একই সুরে কথা বলেছেন।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পুরো সময়টা জাতীয় পার্টি সঙ্গী হিসেবে থেকে সব কিছুর বৈধতা যেমন দিয়েছে, তেমনি কখনো সরকারি বিরোধী দল, গৃহপালিত বিরোধী দল ছিল। আওয়ামী লীগ যে কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে , সেই একই কারণে জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধ করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সময়ে এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। অথচ এদের কোনো কিছুই হয়নি।

জাতীয় পার্টিকে নতুন করে পুনর্বহাল করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে দাবি করে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে ভোটের সুবিধা কে পেতে পারেন এটা ওইভাবে বলা যাবে না। এটা বিএনপি না জামায়াতের জন্য সুবিধা হবে এটা বলা মুশকিল। আর গত তিন নির্বাচনের যে ভোটের কথা বলা হয়েছে তা তো বিশ্বাসযোগ্য না। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক থাকলেও জাতীয় পার্টির ভোট বেশি দেখানো হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে টিকে ছিল।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে।যেখানে রাষ্ট্রীয় বিশেষ সংস্থা মধ্যস্থতা করছে। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে আবারও বিরোধী দল করার ছক কষা হচ্ছে।

শনিবার গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, ‘আগামীতে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসানোর চক্রান্ত চলছে। এ নিয়ে ডিজিএফআই’র সঙ্গে দলটির দেনদরবার হচ্ছে। জনগণ সে চক্রান্ত প্রতিহত করবে।’

যদিও গণঅভ্যুত্থানের আগে আওয়ামী লীগকে নীরবে সমর্থন দিয়ে যাওয়া জাপা নেতারা দাবি করছেন, তারা শেখ হাসিনার দুঃশাসনের প্রতিবাদ করেছেন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল।

আর নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে উল্টো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, এমন দাবিতে তারা ভীতসন্ত্রস্ত নন। আঘাত আসলে জবাব দেওয়া হবে।

জাপা নিষিদ্ধ নিয়ে কি বলছে দলগুলো

জাপার কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ যখন সরব তখন অনেকটা চুপচাপ বিএনপি। অন্য দলগুলোর কেউ কেউ দল নিষিদ্ধের বিষয়টি জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে চান।

সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজনৈতিক সংকট যতই থাকুক না কেন কোনো একটি ডিক্রি বা অর্ডার জারি করে কাউকে নিষিদ্ধ করার চেয়ে নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রচারণা চালানো উচিত। জনগণ যদি মনে করে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই, তাহলে হবে।

রোববার (৩১আগস্ট) রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াত নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, পতিত আওয়ামী লীগের মতোই জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলেছি, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে যেভাবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

আরও পড়তে পারেন

নুরের ওপর হামলার নিন্দা, জাপা নিষিদ্ধের দাবি হেফাজতের

অন্যদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে বৈঠক শেষে জানানো হয়েছে, তারা জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে দলটির নেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, নিষিদ্ধ পার্টির বিষয়ে অবস্থান নেওয়া ও বিগত সময় অবৈধ সংসদকে বৈধতাদানের তাদের যে পদক্ষেপ সে বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম যাতে স্থগিত করার বিষয়ে সরকার যেন আরও বেশি কার্যকর হয় সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছি আমরা।

এরআগে শনিবার বিক্ষোভ থেকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারকে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেছেন, আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টি ও একই দোষে দোষী। ১৪ দলের বৈঠক থেকেই শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার সিদ্ধান্ত হয়। তাই তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। 

অন্যদিকে শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন জুলাই মঞ্চের নেতারা।

নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে কি বলছে জাপা

এরআগে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি জানানোর পর দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার দাবি অযৌক্তিক। কারণ নির্বাচন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে (RPO) জাপা সেই শর্তে পড়ে না।

দল নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে জাপার একাংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, এই মুহূর্তে অনেকেই জাতীয় পার্টিকে ব্যান করার কথা বলছে। জাতীয় পার্টি কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেনি, তাই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা, আরপিও অনুযায়ী দলের নিবন্ধন বাতিল করার মতো কিছু করেনি জাতীয় পার্টি। এই দাবি তোলা অযৌক্তিক। এমন দাবিতে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত নই। আমরা আশা করছি, সরকার ভ্রান্ত দাবিতে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না।

বিইউ/এএস