মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম
৫ আগস্ট সকাল ১০টা। সেদিনই ঢাকা শহরে চলছিল কারফিউ। তবে এই কারফিউকে অমান্য করে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা শহীদ মিনারে আসতে শুরু করে। প্রায় এক থেকে দেড়শ ছাত্রে শহীদ মিনারের বেদী ভরে যেতে থাকে। হঠাৎ সেখানে হাজির হয় কয়েকশ পুলিশ। এতে নেতৃত্ব দেন এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) আশরাফুজ্জামান।
এই দুই কর্মকর্তার নির্দেশে সেখানে থাকা ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। সেই সঙ্গে চলে বেধড়ক মারপিট। সেদিন পুলিশের প্রথম আক্রমন শুরু হয় শহীদ মিনার থেকে, যা ছিল ‘ওপরের’ নির্দেশ। সেখানে দায়িত্বপালনকারী প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া গেছে।
সেখানে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরা জানান, ছাত্ররা সবেমাত্র জড়ো হয়েছে। ওই সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দুই দিক থেকে হঠাৎ পুলিশের দুটি টিম আসে। তারা তদের কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নির্বিচারে গুলি শুরু করে। এছাড়াও ধাওয়া দিয়ে চলে বেধড়ক মারধর। ছাত্রদের হাত ছিল শূন্য। বেশির ভাগ ছিল উঠতি যুবক, শিশু ও মাদ্রাসার ছাত্র। তারা শত শত পুলিশ দেখে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে।
সেদিন সকাল ১০টার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসে ঢুকে পড়েন সময়টিভির দায়িত্বরত সাংবাদিক আজহার লিমন (বর্তমানে তিনি এখন টেলিভিশনে কর্মরত)। লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, “সেদিন সকাল ১০টার আগেই ঢাবিতে যাই। রাজু ভাস্কয্যের সামনে গাড়ি থেকে নেমেই দেখি, শাহবাগ থেকে এডিসি শুভর নেতৃত্বে একটি দল হুড়মুড় করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে। তখন ঢাবি ক্যাম্পাস পুরো সুনসান। কোনো হল থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না পুলিশ। সেখানে এক ধরনের আগ্রাসী ভূমিকা দেখেছি শুভর। তখন ইন্টারনেটও ছিল না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে গিয়ে দেখছি, দেড় থেকে দু্ইশ ছাত্র দাঁড়িয়ে গেছে। সেদিন ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল আন্দোলনরত ছাত্রদের।
সেখানে সবার আগে কায়েস নামে এক এডিসি গিয়ে সাউন্ডগ্রেনেড ছোড়েন। এরপর ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় জানিয়ে আজহার বলেন, এরপরই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে ছাত্রদের ধাওয়া দিয়ে পেছনে নিয়ে গেল পুলিশ। মুহূর্তে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছড়িয়ে পড়ে হাসিনার দলীয় পুলিশের ভয়াল থাবা। প্রায় ২০ মিনিট চলে গুলি, পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধরকাপড়। পুলিশ এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে সেখানে দায়িত্বপালনকারী আশরাফ ( গত বছরের ৩১ জুলাই অতিরিক্ত কশিমনার পদে পদোন্নতি পান) উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে বলছিলেন, তোমাদের কালকে মারছে না (আন্দোলনকারীরা)? তোমরা আজ কী করবা? তার এমন কথায় পুলিশ সদস্যরা জবাব দিয়েছিল, স্যার আজকে আমরাও মারব।
পুলিশ যাতে আক্রমণাত্মক হয় এভাবে উস্কে দিয়েছিলেন আশরাফুজ্জামান। সেদিন সেখানে আশরাফুজ্জামান ছাড়াও এডিসি এএসপি শুভ, আকতার ও এএসপি কায়েস (গায়ের রং কালো, উচ্চতা খুব বেশি একটা লম্বাও না) ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালন করে। এরা সবাই মারমুখী ও হিংস্র একটা অবস্থায় ছিল। এদের মধ্যে এডিসি কায়েসের ভূমিকা ছিল ভয়ঙ্কর। তখন তার মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছিলো বলেও জানান লিমন। আমরা (সাংবাদিকরা) সেখানে দাঁড়াইছি, তারা অস্বস্তি ফিল করছিল বলেও যোগ করেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক লিমন।
এরপর কী ঘটে তা তুলে ধরে লিমন আরও বলেন, তখন ঢাকা মেডিকেলের দিক থেকে পুলিশের এপিবিএনের একটি টিম এসে ঘিরে ফেললো। ধরপাকড় চললো। এর মাঝে দু্ই ছাত্র শহীদ মিনার থেকে রিকশাযোগে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাচ্ছিলো। তখন তাদের আটক করা হয়। শুধুমাত্র ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব’ বলে স্লোগান দেওয়ার কারণে। তাদের পুলিশ মারধর করলো এবং বলছিল, কী রক্ত দিবি?
প্রথমে ছাত্রদের ধাওয়া দিতে শুরু করে পুলিশ। এরপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। সেই সময় চোখের সামনেই এক ছাত্রকে খুব কাছ থেকে গুলি করতে দেখেছেন সাংবাদিক কামরুজ্জামান বাবলু। তিনি তখন ইংরেজী দৈনিক নিউ নেশন পত্রিকায় কাজ করতেন। সেদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে বাবলু বলেন, সেদিন শহীদ মিনারে ফজরের পর আন্দোলনকারীদের একটি গ্রুপ অবস্থান নিয়েছিল। তারা সকলে বহিরাগত ছিল। তাদের সঙ্গে পানি, কলা, রুটি ছিল। পুলিশ গিয়ে সেখানে নির্বিচারে গুলি করেছিল।
বাবলু বলেন, “সবচেয়ে বড় প্যাথেটিক। আমার চোখের সামনেই এক দুই হাত দূরত্বে পেছন দিক থেকে এক যুবককে গুলি করা হলো। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে। ঘটনা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে আমি বাঁচবো নাকি তাকে বাঁচাবো। সেখান থেকে তাকে যে মেডিকেলে নেব রিকশাও নাই। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে তাকে দুই তিনজনের হাতে তুলে দিলাম। তাদের বললাম, যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সে বেঁচে ছিল কি না জানি না।” সেখানে আসা বহিরাগত ছাত্রদের অধিকাংশকে গুলির পাশাপাশি নির্বিচারে পেটানোও হয়েছিল বলে জানান বাবলু।
এমআইকে/ক.ম