০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৮ পিএম
সেদিন ছিলো সোমবার। প্রায় ১৬ বছর পর চব্বিশের সেই দিন (৫ আগস্ট) পরাজয় হলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। দেশের গণমানুষের কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের জেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে যান হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও শীর্ষ নেতারা।
৫ জুন। এদিন ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এই রায়ের প্রতিবাদে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শুরু হয় বিক্ষোভ। এরপর সারাদেশে শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ সভা-সমাবেশ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। প্রথম দিকে আন্দোলন তীব্রতর না হলেও ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো, কি রাজাকারের নাতি পুতিরা কোটা পাবে?” এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ঢাবি, রাবি, জাবি, চবি সহ দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ দিনই পাকাপোক্ত হয়ে যায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন।
এরপর ঢাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর জন্য তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ঢাবি এলাকায় ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। এসময় ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, সেখানেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রড ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়।
এরপর ১৬ জুলাই সারাদেশে হওয়া বিক্ষোভে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন। আবু সাঈদ হত্যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে ঢাবি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তাড়িয়ে দেয় এবং হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আন্দোলনে নিহত সকলের জন্য গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করা হলে সেখানেও হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দু’দিন পর (১৮ জুলাই) শিক্ষার্থীরা সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাট ডাউন’ ঘোষণা করে। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট সরকার সারাদেশের আন্দোলন দমানোর জন্য টানা ছয়দিন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে দেয়। এরপরও ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নানাভাবে যোগাযোগ করে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

পরদিন ফ্যাসিস্ট সরকার সারাদেশে কারফিউ জারি করে এতে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ৬৬ জন এর অধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২৬ জুলাই পুলিশ বাহিনী সারা দেশে ‘ব্লক রেইড’ চালায়। এসময় তারা আন্দোলনের সমন্বয়কারী- নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এবং আবু বকর মজুমদারকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা আরও দুই সমন্বয়কারী সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে হেফাজতে নেয়। এসময় শিক্ষার্থীরা সমন্বয়কদের মুক্তির দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। ২৭ জুলাই পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ১২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই গ্রেফতার হয়েছেন ২ হাজার ৫৩৬ জন।
পরদিন (২৮ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে রাত ৯টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে রেকর্ড করা একটি ভিডিও গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, যেখানে পূর্বে হেফাজতে নেওয়া ছয় সমন্বয়কারী সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান। তবে, তিন সমন্বয়কারী- মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের এবং আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেছেন যে, ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বার্তাটি বিক্ষোভকারীদের আসল অবস্থান নয়। সমন্বয়কারীদের ডিবি কার্যালয়ে জিম্মি করা হয়েছিল এবং বার্তা পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
পরদিন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয় সরকার। পাশাপাশি, সারা বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ ব্যানারে ছাত্র হয়রানি ও গণগ্রেফতার বন্ধের আহ্বান জানান। তারা আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানান এবং চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। সকালে ঢাবির অপরাজেয় বাংলায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে এক মুহূর্ত নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়, যাকে শিক্ষকরা ‘জুলাই গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৩০ জুলাই, যারা সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে তাদের স্মরণে সরকার একটি ‘শোক দিবস’ পালন করে, কিন্তু ছাত্ররা দিনটিকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল লাল করে দেয় এবং রাজধানীসহ অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ করে। চলমান নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশে ছাত্ররা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করে। দুপুর সোয়া ১টার দিকে বুয়েট, ঢাবি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের দিকে মিছিল করে যাওয়ার সময় পুলিশ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা ও ঢাবি সাদা দলের শিক্ষকরা দোয়েল চত্বরে জড়ো হয়।
পরদিন, ১ আগস্ট তৎকালীন সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের পাশাপাশি এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরদিন, ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সংগঠক বলেন ডিবি অফিস থেকে প্রত্যাহারের বিবৃতি স্বেচ্ছায় দেননি। ৩ আগস্ট সরকারের পতন ঘটে যায়; যেদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপুল জমায়েত থেকে ‘এক দফা’ ঘোষিত হয়। এরপর ঢাকা এবং দেশের অন্তত ২১টি জেলায় ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে ১৪ পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৯১ জন নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে দিনটি বিক্ষোভের সবচেয়ে মারাত্মক সময় হয়ে উঠলে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে।

সবশেষে ৫ আগস্ট অর্থাৎ ৩৬ জুলাই, দেশের চলমান কারফিউ অমান্য করে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশ থেকে মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করে। দুপুর নাগাদ গণভবনে লাখ লাখ মানুষের সমন্বয়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। হাসিনার পতন সেই মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেও লক্ষাধিক লোকের বিপক্ষে দাঁড়ানো অসম্ভবপর হয়ে ওঠে। বিকেলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে তার পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করেন হাসিনা। এরপর হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বিমানে করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং পরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্যসচিব জাহিদ আহসান গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগস্টের ২ তারিখে অর্থাৎ ৩৩ জুলাই দ্রোহযাত্রা সফল করার লক্ষ্যে সেদিন জুমা’র পরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে। বাইনারি সৃষ্টি করতে যেভাবে দুটি পক্ষকে ভাগ করে রাখা হয়েছিল, তা ওই মিছিলে সেদিনই ভেঙে যায়। সেদিন একই মিছিলে টুপি পড়া, পাঞ্জাবি পড়াসহ সব মানুষ হাসিনার পতনের দাবিতে নেমেছিল।
জাহিদ আহসান বলেন, ৪ তারিখ রাতেই আমরা সকলে আলোচনা করলাম, আগামীকাল হাসিনাকে আমরা ফালায় দিমু। এরপর ওইদিন আসিফ ভাই ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা দেয়। যার পরপরই সারাদেশ থেকে মানুষ সকল বাঁধা পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে থাকে। এরপর শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়ার কথা আমরা শুনতে পাই। তখনই আমরা বুঝেছিলাম বিজয় চলে এসেছে, এবার আমাদের ছাত্রদের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

৫ আগস্টের দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, যখন দেখলাম আর্মি চিফ বক্তৃতা দিচ্ছিল তখন বুঝেছিলাম শেখ হাসিনা অলরেডি গন (ইতোমধ্যে বিদায়)। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আর্মি চিফ-এর বক্তৃতা দেখার জন্য গিয়ে দেখলাম যে লোকগুলো এতোদিন ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে ছিলো তারাও ওখানে হাজির, রাতারাতি সব বদলে গেল।
বিইউ/ক.ম