বোরহান উদ্দিন
০১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
- ছয় মাসে নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষ হয়েছে ৩শ বারের বেশি,
- প্রাণ গেছে ৪৬ জনের, আহত প্রায় তিন হাজার
- হার্ডলাইনে হাইকমান্ড, বহিষ্কার ছাড়িয়েছে ৪ হাজার
- অপরাধীর অন্য কোনো পরিচয় নেই, সে অপরাধী: বিএনপি
- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দায় সরকারের: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টায় হাইকমান্ড তখন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। আধিপত্য বিস্তার, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও দখলকেন্দ্রিক সহিংসতায় জড়ানোর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। হামলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতারাও। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে দেশের ৫ শতাধিক রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে বিএনপির অন্তঃকোন্দলের ঘটনায় ৩ শতাধিক। সহিংসতার ঘটনায় মারা গেছেন ৪৬ জন নেতাকর্মী। আহত ৩ হাজার ছুঁইছুঁই।
এদিকে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িত থাকায় চার হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়েছে। ধরে পুলিশে দেওয়ার ঘটনাও আছে। আবার শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে অপরাধীদের বিষয়ে দেওয়া হচ্ছে কড়া বার্তা। কিন্তু সব যেন বিফলে যাচ্ছে। প্রায়ই নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে রক্তাক্ত হচ্ছে তৃণমূলের জনপদ। সবশেষ মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দলের নেতাকর্মীদের গুলিতে আহত হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খন্দকার।
এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসলে এমন সংঘাত আরও বাড়বে। বিশেষ করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়তে পারে। তাই বিএনপিকে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সংঘাতের ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটছে। বিএনপি ব্যবস্থা নিচ্ছে। আরও কঠোর হতে হবে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি সেই জায়গায় যেতে হলে এসব শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে। নেতাকর্মীরা হয়তো এখনও সেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে না।’
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক তাকে অপরাধী হিসেবেই আমরা বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’
ছয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গত ৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে ছয় মাসে সারাদেশে ৫২৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি। এতে মারা গেছেন ৭৯ জন। আর ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ১২৪ জন।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর অদ্যাবধি আরও একাধিক সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে বিএনপি বনাম বিএনপি, বিএনপি বনাম জামায়াত, এনসিপি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জড়িয়েছেন।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রাজনৈতিক সহিংসতার ৫২৯টি ঘটনার মধ্যে বিএনপি-বিএনপিতে ঘটেছে ৩০২টি। এতে মারা গেছেন ৪৬ জন। আর আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২ হাজার ৮৩৪ জন। একইসময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) মধ্যে ১০১টি সংঘর্ষে আহত হন ৫০২ জন এবং নিহত হন ১৬ জন।
ছয় মাসে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ২৬ বার সংঘর্ষে মারা গেছেন দুজন। আহত হন ২১৬ জন। আর এনসিপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির ১১ বারের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৭৯ জন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-এনসিপির মধ্যে ১৮টি সংঘর্ষে আহত হন ৫৪ জন এবং নিহত হন ১ জন। আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে ৭টি সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হন ৯ জন এবং নিহত হন ১ জন।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার–এর গত বৃহস্পতিবার একটি তিন মাসের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত, ১ হাজার ৬৭৭ জন আহতের তথ্য দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী এই তিন মাসে বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ১০৫ বার। এই সংঘাতে প্রাণ গেছে ১৯ জনের।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা আক্ষেপের সুরে বলছেন, আওয়ামী লীগের আমলে যারা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন তাদের চেয়ে নব্য বিএনপি যারা তারা বেশি বেপরোয়া। এদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নিচের সারির কর্মীদেরও দলে টানছেন। কেউ আবার আওয়ামী লীগের লোকদের প্রশ্রয় দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করছেন। যে কারণে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
তারা বলছেন, অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া শুধু কর্মীকে নয়, বরং ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দলে শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। সংঘাতও কমে আসবে।
দলের কর্মীদের হামলায় রক্ত ঝরছে তৃণমূলে
অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে গিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডকে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তৃণমূলের সহিংসতার ঘটনায়। কেন্দ্র থেকে ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কারসহ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছেন না বেপরোয়া নেতাকর্মীরা।
কিছুদিন আগে নিজ এলাকায় কাউন্সিল শেষে ফল ঘোষণার পর পরাজিত নেতার লোকজনের হামলার মুখে পড়তে হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাই মির্জা ফয়সল আমিনকে। দলের নেতাকর্মীদের হাত থেকে নিজে রক্ষা পেলেও তার গাড়িটিও ভাঙচুর করা হয়। ইতোমধ্যে এই ঘটনায় বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ আলম ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. টি এম মাহবুবর রহমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলীয় কোন্দলে মঙ্গলবার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খন্দকার। চট্টগ্রামে রাউজানে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা তার গাড়ি বহরে হামলা করে তছনছ করে দেয়। গুলি করা হয় গোলাম আকবরের দিকে। তিনি দ্রুত গলা সরিয়ে নেওয়ায় বড় বিপদ থেকে বাঁচলেও রক্তাক্ত হয়েছেন গুলির আঘাতে।
রাউজানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার জেরে রাতেই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদও স্থগিত করা হয়েছে।
দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠা রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ হত্যার ঘটনায়ও নামে আসে যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। নিহত সোহাগ যুবদলের সাবেক কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, চাঁদা না পেয়ে তাকে হত্যা করা হয়। সোহাগকে পাথর দিয়ে থেঁতলে দেওয়ার নৃশংস ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এই বিষয়ে চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই ঘটনায় নাম আসায় তাৎক্ষণিক যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের পাঁচজনকে বহিষ্কার করা হয়। হত্যার রহস্য উন্মোচনে বিএনপির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও করা হয়।
গত ২৬ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্যের প্রতিবাদে চাঁদপুরের কচুয়ায় কর্মসূচি পালনের সময় সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির দুই পক্ষ। এতে আহত হয় কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। একই ইস্যুতে আলাদা জায়গায় কর্মসূচি পালন করেন মালয়েশিয়া বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কচুয়া বিএনপির প্রধান উপদেষ্টা মোশারফ হোসেন (মিয়াজী) পক্ষ ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক (মিলন) অনুসারীরা। অথচ একপক্ষের ওপর আরেকপক্ষের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করে কয়েকজনকে আহত করেছে।
এদিকে সোহাগ হত্যার রেশ না কাটতেই আবারও বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দলীয় কার্যালয়ের বকেয়া ভাড়া চাওয়ায় দোকান মালিককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বুধবার (৩০ জুলাই) নারায়ণগঞ্জে এই ঘটনা ঘটেছে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়লে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন সর্বস্তরের মানুষ। রাতে এই ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে বহিষ্কারের কথা জানায় বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর।
কী বলছেন বিএনপি নেতারা
তৃণমূলের এমন সহিংসতা নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপি কোনো অন্যায়ের পক্ষপাতী নয়। আমাদের কর্মীরা যদি ভুল করে, তারেক রহমান নিজে ব্যবস্থা নিয়েছেন, বহিষ্কারাদেশ দিয়েছেন। তারপরও আমাদের বদনাম দেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনে আরও কঠোর হবো। কিন্তু ঘটনা যতটা না বড় তার চেয়ে প্রচার বেশি হয় এটাও মাথায় চিন্তা করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা মেইলকে বলেন, পরিসংখ্যানগত দিক চিন্তা করলে এমন ঘটনা সত্যি উদ্বেগের। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন নয়, আগেও হতো। তবে খুব একটা প্রকাশ পেত না। এখন পুরোপুরি প্রকাশিত হওয়াতে আসল তথ্য আসছে। তবে এটুকু আশ্বস্ত করতে পারি কোনো অপরাধীকে বিএনপি প্রশ্রয় দেয় না। ধরে পুলিশেও দিচ্ছি আমরা। তবে বড় কাজটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে করতে হবে।
আর বিএনপির নির্বাহী কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ঢাকা মেইলকে বলেন, বিএনপি বড় দল। সুযোগসন্ধানীরা ঢুকে অনেক সময় বিশৃঙ্খলতা করছে। কিন্তু সত্যি বলতে আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা, সর্বত্র লুটপাট, দখলবাজির বীজ বপন করে পালিয়ে গেছে তার রেশ এখনো আছে। তারপরও যাতে নেতাকর্মীরা কোনো অপরাধে না জড়াতে পারে সেজন্য নেতৃত্ব শক্তিশালী, বিচক্ষণ হওয়া জরুরি। আমরা রাজশাহীতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হচ্ছি বলে মনে করি।
বিইউ/এএস