images

রাজনীতি

এ এক অন্যরকম ফেরা...

বোরহান উদ্দিন

০৭ মে ২০২৫, ০৯:৫০ এএম

  • মৃত্যু ঝুঁকির শঙ্কার কথা বারবার বলেছেন চিকিৎসকরা
  • বারবার চেষ্টায়ও বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি সরকার
  • খালেদা জিয়ার অভ্যর্থনায় পথে পথে নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস
  • শারীরিক-মানসিকভাবে স্থিতিশীল আছেন খালেদা জিয়া: চিকিৎসক 
  • সুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখে বিএনপি শিবিরে স্বস্তি

২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। নয়াপল্টনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর দাবিতে বিশাল সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় প্রধানের শারীরিক অবনতি স্বচক্ষে দেখে আসার কথা তুলে ধরে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়াকে যেমনটি দেখেছি, এমন অবস্থায় আগে কখনো দেখেনি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেছেন আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। দ্রুত বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে বাঁচানো দুষ্কর হবে।’

মির্জা ফখরুলের সেই কান্নার দৃশ্য ছুঁয়ে যায় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মন। অবশ্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে তখনও বিদেশ পাঠানোর অনুমতি মেলেনি।

মির্জা ফখরুলের এমন আবেগঘন বক্তব্যের কিছুদিন পর ৯ অক্টোবর বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান তার ‘মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি’। লিভার প্রতিস্থাপন করতে দ্রুত নিতে হবে বিদেশে।

চিকিৎসকদের কাছ থেকে এমন বার্তা পাওয়ার পর জিয়া পরিবার থেকে বিএনপির নেতাকর্মী সবার মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে যায়। এরপরও সরকারের দফতরে দফতরে বিদেশ নেওয়ার আবেদন করেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সদয় হননি তখনকার সরকার।

তবে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদকের দায়ের করা মামলার রায়ে কারাগারে নেওয়ার পর দুই বছরে শারীরিক জটিলতা বাড়তে থাকা খালেদা জিয়া কখনো সুস্থ জীবনে ফিরবেন সেই আশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেলেন! কারণ শারীরিক জটিলতা ক্রমেই বাড়ার কারণে এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসা যাওয়া আসার মধ্যেই কাটাতে হয়েছে তাকে অনেকটা দিন। এরইমধ্যে একাধিকবার তাকে নিতে সিসিইউতে। আগে কারও সহযোগিতা নিয়ে হাঁটতে পারলেও কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে তার হুইল চেয়ার।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের দিনে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। মুক্তি পেয়ে গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাওয়া থেকে চার মাস পর মঙ্গলবার দেশে ফেরা পর্যন্ত হুইল চেয়ারেই দেখা গেছে তাকে। তবে এদিক দুপুরে নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় দুই পুত্রবধূর হাত ধরে হেঁটে ভেতরে ঢোকার দৃশ্য যেন সব শঙ্কা দূর করে দিয়েছে। সুস্থ বেগম জিয়াকে দেখে নেতাকর্মীদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের ছাপ।

যেভাবে শারীরিক জটিলতায় পড়েন খালেদা জিয়া

আগে থেকে বাতব্যথাসহ বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা থাকলেও টানা দুই বছর কারাভোগের পর অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে ২০২০ সালের মার্চে বাসায় ফিরেন খালেদা জিয়া। প্রথমে অসুস্থতার কারণে কারাগার থেকে কয়েক দফায় খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা দেওয়া হয় তৎকালীন শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে পরিত্যক্ত কারাগারে রাখার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ায় তার শারীরিক জটিলতা বেড়েছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন দাবি করা হয়েছে, তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন।

9

ওই সময় বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশে পাঠাতে বারবার আবেদন করলেও তা নাকোচ করে দেওয়া হয়। উল্টো সরকার প্রধান শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা অসুস্থতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করে প্রকাশ্যে বক্তব্যও রেখেছেন।

এদিকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য ২০২১ সালের এপ্রিলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় নেওয়ার পর তার লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানান। ওইসময় চিকিৎসার জানান, খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসসহ অনেকগুলো জটিল রোগ থাকায় তার লিভার সিরোসিস জটিলতর হতে পারে। যে কারণে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিদেশি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

হাসপাতালই হয়ে ওঠে খালেদা জিয়ার বাসা!

২০২১ সালের নভেম্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খালেদা জিয়ার একাধিকবার খাদ্যনালিতে সংক্রমণ ও রক্তপাত হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে তার পেটে পানি আসার সমস্যা, অ্যাসাইটিস শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে তার এই সমস্যার সমাধান বাসায় রেখে করার চেষ্টা করলেও ওই বছরের আগস্টের শুরু থেকে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তাকে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর জানা যায় যে তার পেটের পানি জীবাণু দিয়ে সংক্রমিত হয়েছে।

10

চিকিৎসকরা তখন জানান, চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় ইন্ট্রাভেনাস সেন্ট্রাল লাইনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার রক্তে সংক্রমণ, সেপটিসেমিয়া তৈরি হয়। এর মধ্যে তার পেটে পানি বাড়তে থাকে এবং পেট থেকে পানি ফুসফুসে প্রবেশ করে। যে কারণে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একাধিকবার খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে রাখা হয়।

পরবর্তীতে চিকিৎসকরা জানান, খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হলে দীর্ঘ সময় সুস্থভাবে বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। 

অবশেষে দ্বার খুলে বিদেশে চিকিৎসার

৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় বহরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান।

সেখানে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। টানা ১৭ দিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ২৫ জানুয়ারি থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন।

8

দেশে ফেরার যাত্রা

চার মাস পর লন্ডনের স্থানীয় সময় সোমবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়াকে নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। পথে দোহায় যাত্রা বিরতি দিয়ে উড়োজাহাজটি ঢাকায় পৌঁছায় মঙ্গলবার সকালে।

ফেরার পথে তার সঙ্গী হয়েছেন দুই পুত্রবধূ- তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথিসহ ১৩ জন।

বিমানবন্দরে বিএনপি চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

7

খালেদা জিয়া ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে থেকে গুলশানের বাসায় পৌঁছান সাদা রঙের এসইউভিতে করে। সাধারণত তিনি গাড়ির সামনের আসনে বসেন না, কিন্তু এদিন ব্যতিক্রম দেখা গেল। পেছনের আসনে ছিলেন তার দুই পুত্রবধূ।

ফিরোজায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান তার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দু এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা।

পথে পথে উচ্ছ্বাস

নেত্রীকে বরণ করে নিতে এদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের খিলক্ষেত, কুর্মিটোলা, বনানী, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নেন।

তারা পিকআপ কিংবা বাসে করে গান বাজাতে-বাজাতে দলের পতাকা, দেশের পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন সড়কে। কেউ-কেউ মাথায় দলের পতাকা লাগিয়ে আসেন। কারো হাতে শোভা পায় দলীয় ব্যানার, ফেস্টুন। কোনো কোনো গ্রুপ আসেন ব্যান্ডপার্টি নিয়ে।

11

খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতাকর্মীদের ভিড় সামলাতে ঢাকা মহানগর পুলিশও বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তায় হালকা যানবাহন চলাচলের সুযোগও থাকে।

জনসাধারণকে এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান-বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব পরিহার করে বিকল্প রাস্তায় চলাচলের অনুরোধ করা হয়।

বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীদের অবস্থানের ফলে কোনো পূর্ব নির্দেশনা না থাকলেও ‘বাধ্য হয়ে’ বনানী থেকে গুলশানগামী সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।

8

১৭ বছর পর দেশের মাটিতে জুবাইদা

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থার সময়ে দেশ ছাড়ার পর থেকে স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনেই ছিলেন জোবাইদা রহমান। ১৭ বছর পর শাশুড়ির সঙ্গে তিনি দেশে ফিরলেন।

আপাতত তিনি ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়কের বাবার বাড়ি ‘মাহবুব ভবন’ এ থাকবেন। সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের বাসভবন এটি। ওই বাড়িতে থাকেন মাহবুব আলী খানের স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় মেয়ে শাহীনা জামান ও তার পরিবারের সদস্যরা।

কেমন আছেন খালেদা জিয়া

গুলশানে ‘ফিরোজা’র সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, উনি অনেকটা শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ফেরত এসেছেন। চিকিৎসা পরবর্তিতে উনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ… অনেকটুকু উনি সুস্থ আছেন। মানসিকভাবেও উনি স্টাবেল (স্থিতিশীল) আছেন।

বিইউ/এএস