বোরহান উদ্দিন
২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৯ এএম
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দল গঠনের হিড়িক পড়েছে। কর্মী-সমর্থকদের দেখা নেই, দলের কার্যালয়ের হদিস নেই এমন লোকজনও ঘোষণা করছেন নতুন দল। যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে রাজনীতির ভেতরে-বাইরে। তবে সবকিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) রেখে সদ্যঘোষিত নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’- দলে যোগ দেওয়া শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফরকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। কারণ আওয়ামী লীগ, বাকশাল, জাতীয় পার্টি, পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনীতি করে আসা এই নেতা সবশেষ বিএনএমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই আবার নতুন দলে যোগ দিয়ে অনেকের কাছে ‘পল্টিবাজ’ নেতার আখ্যা পেয়েছেন তিনি।
সব মিলিয়ে আটবার দল পাল্টানো শাহ জাফর ভোটের আগে আবারও দল বদল করবেন কি না এমন প্রশ্ন করছেন অনেকে। যদিও বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন আর কোনো দলে তিনি যাবেন না। তবে বিএনপির ডাক পেলে পুরনো দলে ফিরতে আপত্তি নেই।
নতুন দলে যোগ দেওয়ার সপ্তাহ না পেরোতেই ঢাকা মেইলকে মুঠোফোনে শাহ আবু জাফর বলেন, ‘আর কোনো দলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবে বিএনপিতে ফিরে আসতে পারি। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া তো আর দলে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা যদি মনে করেন তাহলে ফেরা সম্ভব।’
কেন শাহ জাফরকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা?
ফরিদপুর-১ (আলফাডাঙ্গা-বোয়ালমারী ও মধুখালী) এই আসনের চরবারের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। রাজনীতিবিদ হিসেবে যতটা আলোচিত হয়েছেন তার চেয়ে বারবার দল বদল করে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়া শাহ জাফর প্রথম সংসদ সদস্য হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে। পরে বাকশাল থেকেও এমপি হয়েছেন। জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) দল থেকেও সংসদ সদস্য হয়েছেন। আবার বিএনপিতে যোগ দিয়ে অল্প কিছুদিনের জন্য সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে থাকলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনএম নামের একটি দল খুলে আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় অস্বাভাবিকভাবে নিবন্ধন নিয়ে ভোটেও অংশ নেন। কিন্তু একতরফা নির্বাচনে ভাগ্য সহায় হয়নি বিএনএমের কারও। ভোটে জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়।
এদিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনএম থেকে চলে যেতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় পদে থাকা নেতারা। পরিস্থিতি প্রতিকূলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় দলের চেয়ারম্যান শাহ জাফরও নতুন সঙ্গী খুঁজতে শুরু করেন। পেয়েও যান।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আওয়ামী লীগের সময় নিবন্ধন পেয়েছি আমরা তাই ৫ আগস্টের পর সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যে যার মতো অনেকটা দূরে সরে যান। এদিকে নতুন এই প্লাটফর্ম থেকে যোগাযোগ করা হলে চারদল মিলে একটা দল শুরু করলাম।’
কী করতে চায় ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’?
ইলিয়াস কাঞ্চন-শওকত মাহমুদের নেতৃত্বাধীন নতুন এই দলে শাহ জাফরের বিএনএম, ইনসাফ কায়েম পার্টি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) ও জাতীয় পার্টি (মিলন অংশ) এক ছাতার নিচে এসেছে। রাজধানীর পরিবাগে নতুন কার্যালয় নেওয়া হয়েছে।
পরবর্তী ভাবনা নিয়ে শাহ জাফর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা চারটা দল একত্রিত হয়ে একটা শক্তিশালী সংগঠন করতে চাই। লোকজনের অংশগ্রহণও ভালো হয়েছে। প্রচার মাধ্যমেও সাড়া পেয়েছি। আপাতত যাদের নাম ঘোষণা হয়েছে তাদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সবার মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা আছে। কোনো সময় লাইসেন্সগিরি, দুর্নীতি করিনি। জুলুম করেছি এটা বলতে পারবে না। তাই ক্লিন ইমেজের মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছি। দুর্নীতিমুক্ত ও অন্যায়মুক্ত দেশ গড়তে কাজ করছি।’
এই নেতা বলেন, ‘মে মাসের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়ে যাবে আশা করি। আগামী মাসের মধ্যে নিবন্ধন চাওয়ার প্রক্রিয়াও শেষ হবে আশা করি।’
শাহ জাফরের মুখে দল পাল্টানোর ব্যাখ্যা
শাহ জাফর ১৯৬৯-৭০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ভিপি হন। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর বৃহত্তর ফরিদপুর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু করে পরবর্তী সময়ে আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে এসে পরে বাকশালের সরদার আমজাদ গ্রুপে যোগ দেন শাহ জাফর। প্রথমে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে ফরিদপুর-১ আসন থেকে এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ সালে বাকশাল থেকে সংসদ সদস্য হন। এরপর ১৯৮৮ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং ২০০৫ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য হন। সবমিলিয়ে তিনি ৯ বার সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
জাতীয় পার্টিতে ভাঙন হলে নাজিউর রহমানের সঙ্গে যোগ দিলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ফরিদপুর-১ আসনে লড়ে পরাজিত হন। ২০০৫ সালে উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অল্প কিছুদিনের জন্য এমপি নির্বাচিত হন শাহ জাফর। ১/১১-তে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সংস্কারপন্থীর তকমা পান।
২০০৮ ও ২০১৮-তেও ফরিদপুর-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন শাহ্ জাফর। ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। কিন্তু ২০২৩ সালে বিএনপি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট-বিএনএম-এ যোগ দেন এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারান।
২০২৩ সালের নভেম্বরে বিএনএমে যোগ দিলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফের দল পাল্টালেন শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর। এভাবে করেই আটবার দল পরিবর্তন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশে তাকে করা হয়েছে উপদেষ্টা।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই তাকে বলছেন ‘পল্টিবাজ’ রাজনীতিবিদ। বিষয়টি কি আসলেই এমন- জানতে চাইলে শাহ জাফর বলেন, ‘আমি আসলে আওয়ামী লীগের লোক। এই দলে ছিলাম। কিন্তু যখন ভাগ হয় তখন আব্দুর রাজ্জাকের ভাগে পড়ে গেলাম। শেখ হাসিনা যখন দল গঠন করলো তখন আমরা একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেলাম। পরে বাকশাল করে সরদার আমজাদ আমাকে মহাসচিব করলেন। নির্বাচন করে বিজয়ী হলাম। এরপর আবার সরদার আমজাদ জাতীয় পার্টিতে গিয়ে আমাকে বহিষ্কারের ভয় দেখালেন পার্টি প্রধান হিসেবে। পরে তাদের প্রেশারের মুখে জাতীয় পার্টিতে গেলাম। আমাকে এরশাদ সাহেব যা চাই তাই দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গেলেন।’
এরপর দল পাল্টানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ভাঙার পর আমি নাজিউর রহমানের পক্ষে পড়ে গেলাম। পরে বিএনপির সঙ্গে সে জোট করার পর এলাকার লোকজন বিএনপির জোটে থাকতে বললেন। তখন আমাকে বিএনপিতে দেওয়ার জন্য নাজিউর রহমানকে অনুরোধ করেন খালেদা জিয়া। পরে বিএনপির সঙ্গে চলে আসলাম। বিএনএম গঠনের আগ পর্যন্ত বিএনপিতেই কিন্তু ছিলাম। সবশেষ নতুন দলে আসলাম।’
নতুন কোনো দলে আবার যাবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর কোনো দলে যাওয়ার সম্ভাবনা বা ইচ্ছে নেই। তবে দলের অনেকে বলছেন, আপনি আবার বিএনপিতে ফিরে যান। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া তো আর দলে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
তাহলে কি বিএনপিতে ফেরার অপেক্ষায় আছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তেমন না। আমি যদিও আওয়ামী লীগের লোক তবুও বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি ফলে তারা যদি লেন তখন চিন্তা করা যেতে পারে দলে যাবো কি না। তাছাড়া অন্য কোনো দল করার সম্ভাবনা নেই।’
বিইউ/জেবি