বোরহান উদ্দিন
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৫ পিএম
ঢাকার সরকারি বাঙলা কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ইবরাহীম বিপ্লব। সম্প্রতি ফেসবুকে মায়ের সঙ্গে তিন ভাই ও বোনের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর পরে মায়ের সাথে আমরা চার ভাই বোন এক হওয়ার সুযোগ পেলাম।’ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজের ঘরে ঘুমাতে না পারা এবং পরিবারের সবার সঙ্গে একত্র হওয়ার সুযোগ মেলেনি এই ছাত্রদল নেতার মতো লাখ লাখ নেতাকর্মীর। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর বছরের শেষ দিকে এসে অনেকটা ভয়-ডরহীন পরিবেশে চলছেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতনে সক্রিয় ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরাও। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর রাজনীতিতে ব্যাকফুটে থাকা বিএনপি অনেকটা ‘চালকের আসনে’ চলে এসেছে। আওয়ামী লীগের পতনে ফুরফুরে মেজাজে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতারা গত ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস হতে চলছে, এখনো নির্বাচনের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়ায় কারও কারও মধ্যে আবারও এক-এগারোর ভূত চেপে বসে কি না সেই দুশ্চিন্তায় পড়েছে দলটি। এ নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্যও দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতে নানা রাজনৈতিক মেরুকরণের মুখোমুখি হওয়া বিএনপির বছরের শেষটা আতঙ্কমুক্ত কেটেছে ঠিকই, তবে অজানা দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নীতিনির্ধারকদের।
তবে এতকিছুর পরও দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা হয়ে পড়া, বাড়িঘর ছেড়ে, কারাগারে বছরের পর বছর কাটানো নেতাকর্মীরা স্বপ্ন দেখছেন আগামী দিনে জনগণের ভোটে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার। অবশ্য সামনের নির্বাচন অতীতের চেয়ে কঠিন হবে- এমনটা জানিয়ে ভোটে জেতার জন্য মানুষের মন জয় করার নির্দেশনা দিয়েছেন খোদ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নেতাদের কারাগারে রেখেই নির্বাচন
বিগত বছরের শুরুর দিকেই নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাদের একে একে কারাগারে পাঠানো হয়। একদিকে হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে, অন্যদিকে বাইরে থাকা বেশিরভাগই ঘরছাড়া, এমন অবস্থার মধ্যেই হয়ে যায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে পরবর্তী সময়ে কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এদিকে নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি দীর্ঘ ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকে পুলিশের দেওয়া তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পান বিএনপির নেতাকর্মীরা।
হালে পানি পায়নি দল ভাঙার চেষ্টা
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিএনপি ভাঙার তৎপরতা অনেকটা দৃশ্যমান ছিল। ভোটে যেতে চাপ, প্রলোভন কোনো কাজে আসেনি। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতার, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমকে সামনে আনা হয় সরকারের মদদে। কিন্তু ঝালকাঠির ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একরামুজ্জামান ও ফরিদপুরের শাহ আবু জাফর ছাড়া কোনো নেতা ফাঁদে পা দেননি। ফলে ভেস্তে যায় শেখ হাসিনা সরকারের চেষ্টা, অন্যদিকে প্রমাণ হয় দলের প্রতি নেতাদের প্রতিশ্রুতি।
অবশ্য মাঝে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগ করে ফেলে। কিন্তু দলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভোটে গিয়ে বহিষ্কারের মধ্যে পড়েন বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী।
শীর্ষ থেকে তৃণমূলে মুক্তির হাওয়া
শেখ হাসিনার পতনের পর ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে শুরু করেন বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূলের কারাবন্দি নেতাকর্মীরা। আইনি প্রক্রিয়া শেষে পুরোপুরি মুক্তি পান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তাকে এখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ একাধিক মামলার সাজা বাতিল হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। এছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাজা বাতিল হওয়ায় অনেকটা স্বস্তির মধ্যে দিন কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তৃণমূলেরও অনেক নেতাকর্মীর মামলা বাতিল হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। বাকি রাজনৈতিক মামলাগুলো বাতিলের আশ্বাসও অন্তর্বর্তী সরকার দিয়েছে।
যে প্রক্রিয়ায় মুক্ত খালেদা জিয়া
বিদায়ি বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম বেগম খালেদা জিয়ার পুরোপুরি মুক্তি লাভ। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত থাকলেও শেখ হাসিনার বিদায়ের একদিন পর সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান।
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করেন। মুক্তির পরপর নয়াপল্টনের সমাবেশে অনলাইনে বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনায় উপস্থিত হন খালেদা জিয়া।
দলের নেতাকর্মীদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়াতে সবার মাঝে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ঢাকা মেইলকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার নামে ৩৭টি মামলা ছিল। ৫ আগস্টের পর বেশির ভাগ খারিজ হয়ে গেছে। সাজা বাতিল হয়েছে। এখন যা আছে তা গুরুতর কিছু নয়। সে হিসেবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আইনগতভাবে সম্পূর্ণ মুক্ত।
তারেক রহমানের ফেরার অপেক্ষায় নেতাকর্মীরা
এক-এগারোর সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান তিনি। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন। মাঝে একাধিক মামলায় তাকে সাজাও দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর তার এসব মামলার সাজা বাতিল হওয়ায় এখন দেশে ফেরার সম্ভাবনা বেড়েছে। নতুন বছরের শুরুর দিকে ফিরতে পারেন এমন গুঞ্জনও আছে।
নেতাকর্মীরাও অপেক্ষায় আছেন কবে ফিরবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে এখনো তার বিরুদ্ধে মানহানির ২৪টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এগুলো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও সাজা হওয়া বাকি মামলাগুলোর শিগগিরই শুনানি হবে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
কঠোর অবস্থানের পরও অপরাধে জড়াচ্ছেন বিপথগামীরা
রাজনীতির মাঠে এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত আওয়ামী লীগ। এ সুযোগে মাঠে একচেটিয়া দখল বিএনপির। দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের ঢল। অনেক সুবিধাবাদীও সুযোগে সামনে আসার চেষ্টা করছেন এমন অভিযোগ খোদ নেতাকর্মীদের। প্রতিনিয়ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিচ্ছেন দেশের সব প্রান্তের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। অন্যায় অপকর্মে না জড়াতে দিচ্ছেন কড়া হুঁশিয়ারি। একের পর এক করা হচ্ছে বহিষ্কার।
কিন্তু চাঙ্গা হয়ে ওঠা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ জড়াচ্ছেন অপরাধে। ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, দখলদারি, ভাঙচুর ও মামলা বাণিজ্যের বদনাম জোটে বিএনপির নামে। টাকার বিনিময়ে স্থানীয়ভাবে পতিত আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ ওঠে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। তবে শুরু থেকে হার্ডলাইনে গিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তারেক রহমান।
নানা অপরাধের অভিযোগে কেন্দ্রীয়ভাবে এক হাজার ৩১ নেতাকে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এক হাজার ২০৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় সম্প্রতি কয়েকজনের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা হয়েছে।
কী বলছেন নেতারা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিদায়ি বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেক ত্যাগ-জীবনের বিনিময়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রমাণ করেছে তারা দলের প্রতি কতটা কমিটেড। যে কারণে জুলুম-নির্যাতনের পরও বিএনপি যে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল তাও প্রমাণিত হয়েছে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোনো আন্দোলনই অরাজনৈতিক হয় না। এটা ভুল কথা। ফ্যাসিবাদ মুক্তির আন্দোলন গড়ে উঠে গত ১৬ বছরে, প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এর চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই-আগস্টে। ৫ আগস্ট চূড়ান্ত ফয়সালা হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় শুধু বিএনপি নয়, গোটা দেশের মানুষ এখন মুক্ত।’
দুদু বলেন, ‘নতুন বছরে এ আন্দোলন কতটা পরিপূর্ণতা দেওয়া যাবে.... তা গণতন্ত্র, স্বাধীনতার পূর্ণতার মধ্যে দিয়ে দেওয়া সম্ভব। এটা অবশ্যই একটা নির্বাচিত সরকারের দ্বারা সম্ভব। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাদের সেবার করার দায়িত্ব দেবে। সেটা যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। আর বিলম্ব হলে ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় মনোবল, তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা দলকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জাগিয়ে তুলেছে। আমরা আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত। আমরা চাই সরকার দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে জনগণের ভোট দিতে পারার আক্ষেপ দূর করবে।’
বিইউ/জেবি