মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৪ এএম
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সেদিন পল্টন এলাকায় শিবিরের কর্মী সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। তারা শুধু তাকে পিটিয়ে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, মাসুমের মৃত্যুর পর তাদের বাসায় গিয়ে তার ঘুমন্ত বাবাকে গভীর রাতে ডেকে তোলা হয়। এরপর এক কাপড়েই থানায় নিয়ে দেওয়া হয় অস্ত্র মামলা। সেই মামলার ঘানি এখনো টানছেন তার বৃদ্ধ বাবা। এখানেই শেষ নয়, তার মা একটি স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করতেন। সেই মাকে জোর করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে।
মাসুম হত্যার ঘটনায় তার পরিবার বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে পলাতক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই মামলাটি আর আলোর মুখে দেখেনি। পরবর্তীতে সেটিকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে দেখিয়ে তুলে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে এই হত্যায় যারা জড়িত সবাই পার পেয়ে যায়। সেই ঘটনার ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বিচার পায়নি মাসুমের পরিবার। এমনকি মামলার বাদী তার ভাই জীবন বাঁচাতে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন।
লগি-বৈঠার আঘাতে নিহত মামুসের পরিবারের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলেও গত ১৮ বছর তারা মুখ খুলতে পারেনি। খোলার সাহসটুকুও পায়নি। কারণ, যদি আবারও হামলা করে বসে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা! তবে এখন বিচারের দায়িত্ব মাসুমের মা সামসুন্নাহার রুবি মহান আল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছেন।
সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম বি.এ.এফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছিলেন। মাসুম বাসাবো মাদারটেকের মাহতাব উদ্দিন আহমেদ ছেলে। তার বাবা একজন সাবেক একাউন্টস অফিসার, মা শামসুন নাহার রুবি শিক্ষিকতা করতেন। মাসুমরা দুই ভাই তিন বোন। বড় ভাই মামলার বাদী শামসুল আলম মাহবুব এখন বিদেশে থাকেন। তিন বোনের একজন অনার্স প্রথম বর্ষ, একজন এসএসসি ও ছোট বোনটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছিল। মাসুম ছাত্রশিবিরের একজন সাথী ছিলেন। ২৮ অক্টোবর হামলার শিকার হয়ে পাঁচদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর আগে তিনি ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগরীর তৎকালীন ২৭নং ওয়ার্ডের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।
‘আমার ছেলে তো কোনো অপরাধ করেনি’
মাসুমের মা সামসুন্নাহার রুবি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার ভদ্র, নম্র ও নামাজী ছেলেটাকে ওরা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, তারা আমার কলিজার টুকরার মাথা পিটিয়ে মগজ বের করে দিয়ে পিষে মেরেছে। পরে ছেলেটা আমার পাঁচদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পরপারে পাড়ি জমায়। সেই অবস্থার পর আমরা একটি মামলা দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার তো দূরের কথা, আটক পর্যন্ত করেনি। পরে সেই মামলাটিও হাসিনা সরকার আর চলতে দিল না। ফলে সেই খুনিদের আর কোনো বিচার হয়নি। সেই ঘটনায় তো শেখ হাসিনা নিজেই লগি-বৈঠা দিয়ে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিল, সেই রেকর্ড তো এখনো আছে। সে তো এটা অস্বীকার করতে পারবে না।’
আমার ছেলে তো কোনো অপরাধ করেনি। সেদিন সে পল্টনে জনসভায় যোগদান করতে গিয়েছিল। এটা কি অপরাধ! একজন নাগরিকের তো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকবে, কিন্তু তাই বলে কি তাকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে? বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মাসুমের মা।
ছেলেকে পিটিয়ে হত্যার পর বাবাকে অস্ত্র মামলা!
মাসুমকে হারানের শোক তখনো পরিবার থেকে মুছে যায়নি। কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ কয়েকদিন পর এক রাতে বাসার দরজায় গিয়ে পুলিশ ও কিছু লোকজন ধাক্কাতে থাকেন। তারা মাসুমের মাকে দরজা খুলতে বলেন। এক পর্যায়ে দরজা খুললে তার পরিবারের সদস্যরা দেখতে পান পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারা ঘরে ঢুকেই পুরো বাড়ি তছনছ করতে থাকেন। এসময় ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মাসুমের বাবাকে ডেকে তোলেন তারা। এরপরের ঘটনা সম্পর্কে মাসুমের মা সামসুন্নাহার রুবি বলেছিলেন, ‘সেই সন্ত্রাসীরা ঘরে ঢুকে আমার ৯০ বছরের বাবার বুকে লাথি মেরে বলছিল, শালা তুই রাজাকার। তুই অনেক লোকজনকে মেরেছোস। অথচ আমার বাবা একটি মসজিদের সেক্রেটারি ছিলেন। সেই বাবাকে তারা বুকে লাথি মেরেছে। অন্যদিকে মাসুমের বাবাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করেছে, মাসুম কি তোর সন্তান? একজন বাবা সন্তানহারা; তারা তা জেনেও তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না দেখিয়ে ঔদ্ধত্য আচরণ করেছে। সেই সময় আমার স্বামীকে তারা প্যান্ট পর্যন্ত পরতে দেয়নি। তাকে তারা টানতে টানতে এক কাপড়ে খালি পায়ে ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে। পরে তার নামে দেওয়া হয় অস্ত্র তৈরি ও সরবরাহের মামলা। যে লোকটা কোনদিন অস্ত্র দেখেনি, তার নামে অস্ত্র মামলা দেওয়ায় এলাকার লোক শুনে হেসেছে। আর বলেছে এত বড় জুলুম আল্লাহ সইবে না।’
চিত্তরঞ্জন দাসের চাপে মাসুমের মাকে চাকরিচ্যুত করে স্কুল কর্তৃপক্ষ!
ছেলেকে হারিয়ে মা অনেকটা পাগলপ্রায়। তবুও সংসার ও চাকরি সামলিয়ে চলছিলেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের কয়েকদিন পর স্কুল কমিটির কাছে মুগদা আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের চাপ আসে। ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষ মাসুমের মা সামসুন্নাহার রুবিকে চাকরি থেকে ছুটিতে পাঠান। সেই থেকে তিনি আর চাকরিতে ফিরতে পারেনি। মাসুমের মা রুবি বলেন, ‘এমন অবিচার আর নির্যাতন পৃথিবীর বুকে মনে হয়ে কোনো পরিবারের সাথে করা হয়নি। আমার বড় ছেলে দেশে থাকতে পারেনি, সারাদিন ঘরে লুকিয়ে থাকত। রাতে বের হতো কিন্তু তাও চুপে চুপে। এভাবে আর কতদিন। এক পর্যায়ে আমরা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেই।’
আল্লাহর আদালতে বিচার দিয়েছেন সেই মা!
২৮ অক্টোবর নিহত সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের মা এখন আর বিচার চান না। তার মতে, তাদের বিচার আল্লাহই করবে। কারণ, তিনি হাসিনার আদালতে ছেলে হত্যার বিচার পাননি। এজন্য তিনি হতাশ। ছেলের বিচার ফ্যাস্টিস্ট হাসিনা সরকারের আদালতে না পেয়ে প্রতি রাত তাহাজ্জুদ পড়েছেন আর মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন এই মা। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি দিন পাঁচ থেকে ছয়বার আল্লাহর কাছে নামাজে দোয়া করতাম যাতে বেঁচে থাকতে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।’
এমআইকে/এমএইচটি