images

রাজনীতি

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, পরিবর্তন আসছে রাজনীতিতে?

ঢাকা মেইল ডেস্ক

২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪১ পিএম

দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে—আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ছাত্রলীগ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের দলীয় লেজুড়বৃত্তি বেড়ে গেছে, যা গত ১৫ বছরে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, এসব কারণে ৭৫ বছরের পুরনো এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার পর, রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিতে কি ধরনের পরিবর্তন আসবে?

বিশ্লেষকরা বলছেন— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বা ছাত্র সংগঠন থাকা উচিত নয়। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে যদি এ পরিবর্তন আসতে পারে, তবে ভবিষ্যতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের কাছে এটি একটি বার্তা হবে। তবে ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না, কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাহী প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ না করে জনসমর্থনের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ হলে সেটি বেশি কার্যকরী হবে বলেও মনে করছেন তারা।

গেল ১৫ বছরে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে, যেমন আর্থিক অনিয়ম, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ। হত্যা মামলায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মৃত্যুদণ্ডের নজিরও রয়েছে। ২০১৯ সালে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কারণে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের বিতর্কিত ভূমিকা ছিল।

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে বিশ্লেষণমূলক বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি মনে করেন— ছাত্র রাজনীতির নামে যা হয়েছে তা মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাম্পাসভিত্তিক অঙ্গ সংগঠন। ছাত্র সংগঠনের প্রকৃত চরিত্র থেকে সরে এসে তারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “ছাত্রলীগ মানে আওয়ামী লীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ছাত্রদল মানে বিএনপির বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। আমি মনে করি এই জিনিসটা একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত। ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষা বা শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে কাজ করাই ছাত্র সংগঠনের কাজ হওয়া উচিত।” মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “নীতিগতভাবে ছাত্র সংগঠনের দলীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে যদি এ বিষয়টি সামনে আনা যায়, তবে আমি মনে করি সামনের দিনে ছাত্রদল বা শিবিরের কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা আসা উচিত।”

তিনি মনে করেন, ছাত্ররা যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী তারা সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে পারে, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি থাকা উচিত নয়। একটা নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিত যে রাজনৈতিক দলের কোনো ছাত্র সংগঠন থাকবে না। যারা ওই দলের সমর্থক তারা সরাসরি ওই দলে করবে, আলাদা করে ছাত্র সংগঠন থাকবে না, এটাই নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। 

রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টি কখনো উত্থাপন করবে না, কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ে যে সংস্কার চলছে, এতে এ বিষয়টি জোরালোভাবে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে ‘ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’তে পরিবর্তন আসবে কি না, সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা বলা মুশকিল। কারণ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যেসব কারণে, সেগুলো একেবারে ইমমিডিয়েট কারণে। গত কয়েক বছরে তারা যে সব কাণ্ডকারখানা করেছে, সেজন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এটি করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজগুলো অন্যরাও করে। তাহলে ছাত্রলীগকে দিয়ে অন্যদের শেখানো না, বরং আমি মনে করি ছাত্রলীগকে ধরেই এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিত। 

এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীন নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জোবায়দা নাসরীন বলেন, “যে নির্বাহী প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত, শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেভাবে সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেটা যদি জনগণের রায় নিয়ে করা হতো, তাহলে আরো শক্তিশালী বার্তা যেত। যে প্রক্রিয়ায় করা হয়, সেটা কিন্তু দেশের জনগণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেটাকে গণতন্ত্রমুখী করার ক্ষেত্রে বার্তা যায় না। নির্বাহী ক্ষমতার আদেশে যখন কিছু বন্ধ করা হয় এবং সেটা যদি জনগণের সমর্থন ছাড়া করা হয়, তখন কিন্তু নতুন কোনো সরকার আসলে সেটা বিশেষ ক্ষমতা আইনে আবার বাতিলও হতে পারে। যেটা আমরা জামায়াতের ক্ষেত্রে দেখেছি।

জোবায়দা নাসরীন বলছেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধকরণের এ সিদ্ধান্তে একটা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ যাবে। যে ম্যালপ্রাকটিসগুলো এতদিন ছাত্র সংগঠনগুলো করেছে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সংগঠনগুলো করেছে, তাদের কাছে বড় ধরনের বার্তা যে এটা করা যাবে না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় সরকার এটা করেছে, তাতে এটা টেকসই প্রক্রিয়া হিসেবে কার্যকর থাকছে না। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে তা আরো কার্যকরী হতো। 

তিনি বলেন, “গণ অভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে। সেটাও নির্বাহী আদেশে হয়েছে। “তাহলে আমার কাছে মনে হয়, এটা যদি জনগণের ম্যান্ডেট হয়ে আসতো, নির্বাহী আদেশে না হয়ে, সংসদ চালু হওয়ার পরে গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটা ডেমোক্রেটিক প্রক্রিয়ায় হলে, এটা সাসটেইন করার গুরুত্ব পেতো। 

আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করছেন, ছাত্রলীগের মতো বড় একটি সংগঠনের নিষেধাজ্ঞা অন্য সংগঠনগুলোর কাছে একটি বার্তা যাবে, কিন্তু ছাত্র রাজনীতির অতীত সংস্কৃতি থেকে সংগঠনগুলো বের হতে পারবে কি না, এটি এখনো বিবেচ্য বিষয়। তিনি বলেন, “এটি নির্ভর করবে নির্বাচন পরবর্তীতে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে, তাদের চাওয়া-পাওয়ার উপর। তারা আসলে কতটুকু চায়, নাকি তাদেরও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আবার ফিরে যেতে পারে। ওই সরকার কী আগে দেশ গঠন করবে, নাকি রাজনীতির পুনরাবৃত্তি করবে, তার উপরে অনেকটা নির্ভর করছে। 

এদিকে, বুধবার সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রমাণ দেশের সকল গণমাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।”

“যেহেতু ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ হইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মুক্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।”

ওই প্রজ্ঞাপনে সরকার জানিয়েছে, পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূল, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সাথে জড়িত রয়েছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। এসব কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি

এইউ