images

রাজনীতি

সাক্কুর বহিষ্কার জাস্ট ফর্মালিটিস!

মো. ইলিয়াস

২১ মে ২০২২, ১১:৪৪ এএম

দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এর প্রতিক্রিয়ায় সাক্কুর ভাষ্য তিনি আজীবন দলের সাথে থাকবেন। এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। তবে বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে যাই বলুন না কেন, অন্দরে সমঝোতা হয়েছে। বহিষ্কারাদেশ জাস্ট ফর্মালিটিস বলে সূত্রের দাবি।

দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় ও দলীয় শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বৃহস্পতিবার বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে মনিরুল হককে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।

বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচন করবে না বিএনপি এমন সিদ্ধান্ত অনেকটাই নিশ্চিত হওয়ায় দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন সদ্যবিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। তার মনোনয়ন বৈধ হওয়ার পর ১৯ মে বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন সদ্যবিদায়ী কুসিক মেয়র সাক্কু। এরপর সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। 

দলের নেতাকর্মীদের সাক্কুর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না রাখতেও বলেছে বিএনপি।

এর আগেও বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে দল থেকে অনেকে বহিষ্কার হয়েছেন। পরে নির্বাচনে জিতে আসলে দল তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীরা দোয়া ও ভোট প্রার্থনার জন্য নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। দল থেকে নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ নিষেধ থাকলেও কুমিল্লায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা যার যার মতো করে মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে কাজ করছেন বলেও জানা গেছে। 

এদিকে মনোনয়ন বৈধ হওয়ার পরে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সভাপতি রাবেয়া চৌধুরীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও দোয়া নেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং বর্তমান মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। এ সময় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও দেখা গেছে। 

স্থানীয় দলের এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিএনপি’র সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে নাকি মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে কাজ করবে জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। 

মনিরুল হকের ভাষ্য, ‘আমি গত ৪২ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। বিএনপি আমার রক্তে মিশে আছে। দল যেই সিদ্ধান্তই নিক, আমি আমৃত্যু বিএনপির সঙ্গে থাকব। কারণ বিএনপির আমার শেষ ঠিকানা।’

কুমিল্লায় দুইবারে মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এরকম ঘটনা পূর্বেও ঘটেছে, পরে দেখা যায় জিতে আসলে দল তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। সাক্কুর ব্যাপারে এরকম হবে কি না জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা আমি আগে কী করে বলব। এটা হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটা আমি নিজে বলতে পারব একা? বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না সেজন্যই। নারায়ণগঞ্জ তৈমুর আলম খন্দকারকে বহিস্কার করা হয়েছে। যেহেতু আমরা দলীয় পক্ষ থেকে বলেছি নির্বাচনে যাব না। কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দলের নেতারা যখন চায় তখন বহিষ্কার করা হয়। সে প্রক্রিয়া বহিষ্কার হয়েছে এখন ভবিষ্যতে কি হয়, সেটা আমি একা বলবো কিভাবে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, সাধারণত জিতে আসলে বিএনপি তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় এরকম কোনো কথা নেই। সাক্কু দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে এ জন্য বহিষ্কার হয়েছে। পরবর্তীতে কি হবে না হবে সেটা এখনো বলতে পারছি না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে দলের ব্যানারে না থাকলে কেউ জিতে আসতে পারে না। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ কোনো ভোট হতে দেয় না সেখানে সাক্কুর জিতে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। বিএনপির ব্যানারে থাকলে হয়তো ফাইট হত, জিতে আসতো সেটা অন্য ব্যাপার। যেহেতু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সে বহিষ্কার হয়েছে পরবর্তীতে কি হবে সেটা জানি না। বর্তমান সরকারের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না। কেউ যদি অংশ নেয় তাহলে দল তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিচ্ছে। 

তিনি বলেন, যদি প্রশাসন র‍্যাব উঠিয়ে নেওয়া হয় তাহলে সব জায়গায় বিএনপি’র ঘাঁটি। মনে রাখবেন ৯৯ শতাংশ বিএনপির ঘাঁটি আর ১ শতাংশ আওয়ামী লীগের। আমাদের একটাই চিন্তা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এই সরকারের অধীনে আমরা আর কোনো নির্বাচনে যাব না। 

জানতে চাইলে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, মনিরুল হক সাক্কুকে সুনির্দিষ্ট কারণে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি দলের সিদ্ধান্তকে ভায়োলেট করেছেন। তাকে মৌখিকভাবে বলে সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সে নির্বাচন করবেই। স্বাভাবিক কারণে তাকে বহিষ্কার করা ছাড়া পার্টির কোনো পথ নেই। যেহেতু আগেও অনেক জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, বহিষ্কার করা এক জিনিস আর আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা আরেক জিনিস। পার্টি এখন শক্ত সিদ্ধান্তে রয়েছে ভবিষ্যতের কথা এখন না বলাই ভালো। এই সরকারের পতন হলে সাক্কু কেন আরও অনেকেই আসতে চাইবে।

২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম কুমিল্লা সিটির নির্বাচনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নাগরিক সমাজের ব্যানারে প্রথমবার এবং ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ দলীয় প্রতীকে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু।

প্রথমবার তিনি হারান আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও প্রভাবশালী নেতা আফজল খানকে; দ্বিতীয় পরাজিত করেন তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে। 

দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় গত ১৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

দলীয় সূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয়বার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে শপথ গ্রহণ শেষে বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন। এ নিয়ে সে সময় দলীয় নেতাকর্মীরা সাক্কুর ব্যাপক সমালোচনাও করেন। এরপর থেকে মনিরুল হক সাক্কু দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে জানা যায়।

দলীয় কর্মকৌশল ঠিক করতে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে গত ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ধারাবাহিক মতবিনিময় সভা করে বিএনপি। সেই বৈঠকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এরই মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কুমিল্লা বিভাগের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মতবিনিময় সভায়ও কুমিল্লার মেয়র অনুপস্থিত ছিলেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে তাকে চিঠি দেয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি। 

২০২০ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এরপর আর জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে তারা অংশ নেয়নি।

গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। তবে গত বছর থেকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে দলের অনেক নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করায় নমনীয় মনোভাব দেখায় বিএনপি। এ সময় দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। কিন্তু এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সে অবস্থান ধরে রাখেনি।

সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অংশগ্রহণ করেন বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকার। ভোটে দাঁড়ানোর পর তৈমুরকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল বিএনপি, হারের পর তাকে দল থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে। তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালও হয়েছেন বহিষ্কৃত।

তৈমুর ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে, সেই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদে। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা বিএনপি দিলেও তৈমুর এবার মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি ভোটের লড়াইয়ে নামলে গত ৩ জানুয়ারি তাকে দুই পদ থেকে সরিয়ে দেয় বিএনপি।

এমই/এএস