images

রাজনীতি

লক্ষাধিক মামলা মাথায় নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি বিএনপির

মো. ইলিয়াস

১৮ মে ২০২২, ১১:০৪ পিএম

প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর মাথায় ঝুলছে লক্ষাধিক মামলার খড়গ। 

শীর্ষ থেকে নিয়ে তৃণমূল, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন এমন বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে অগণিত মামলা। এই অবস্থায় দলটি আন্দোলনে কতটা সুবিধা করতে পারবে সেটা নিয়ে ভেতরে-বাইরে দেখা দিয়েছে সংশয়। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, এসব মামলা সত্ত্বেও তারা আন্দোলনে পিছপা হবেন না। 

বিএনপির দফতর সূত্র জানায়, দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখ ৬০৯টি মামলা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি দলটির যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। তার নামে রয়েছে পাঁচ শতাধিক মামলা। সাবেক ছাত্রদল নেতা ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে তিন শতাধিক মামলা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শখানেক মামলার আসামি। সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগই মামলার আসামি। 

বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের ১৭ মে পর্যন্ত করা এসব মামলায় আসামি প্রায় ৩৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫৭ নেতাকর্মী। এছাড়া এই সময়ে অন্তত এক হাজার ৫২৯ জনকে হত্যা এবং কমপক্ষে এক হাজার ২০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ১১ হাজার ৩২৬ জনকে গুরুতর জখম ও আহত করা হয়েছে বলে দাবি দলটির। 

বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। তবে নেতাকর্মীদের দাবি, এভাবে হয়রানি করেও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যাবে না জাতীয়তাবাদী শক্তিকে।

সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশ পুরনো মামলা সচল হয়েছে। নয় বছর আগের অগ্নিসংযোগের এক মামলায় রাজধানীর মুগদার সাত বিএনপি কর্মীর দুই বছর করে সাজা হয়েছে। এক মামলায় আটক হয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাইরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯১ মামলা, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ৪৫, বেগম সেলিমা রহমান অর্ধশত, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ১৩৬, উপদেষ্টা পরিষদের আমানউল্লাহ আমান ৯১, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শতাধিক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১৩০, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ১০১, যুবদল নেতা এসএম জাহাঙ্গীর দেড় শতাধিক ও ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার ৩১৩ মামলার আসামি।

BNP

নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের মিথ্যে মামলাগুলো মোকাবেলা করছি। চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মিথ্যে মামলায় কারাগারে রয়েছেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে আছেন। আমাদের ৩৫ লাখ লোকের ওপরে মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলো আমরা মোকাবেলা করছি কোনোটা কর্মসূচির মাধ্যমে, কোনোটা আইনগতভাবে।’

ফখরুল বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেওয়া শুরু হয়েছে। আন্দোলন হচ্ছে, সামনে আন্দোলন হবে, এটাকে কেন্দ্র করে এই মামলাগুলো হচ্ছে। আমাদের এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকার পরিবর্তন না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না।’

বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে তা কীভাবে মোকাবেলা করছেন জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে তা আমরা আইনিভাবে মোকাবিলা করছি।’

মামলা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এত মামলা, চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। নিয়মিত আদালতের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, তাছাড়া মামলার পেছনে প্রচুর খরচ রয়েছে। সরকার যেটা করতে চেয়েছে যে, এখানে কোনো কিছু করতে দেওয়া হবে না। কোনো সভা সমাবেশ বক্তব্য কিছুই করতে দেওয়া হবে না। এই বাধার মুখে আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে যেকোনো মামলায় রায় দিতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যাতে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারি সে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা যেকোনো স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকার তো, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কেননা তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বিচার বিভাগ।’

BNP

জানতে চাইলে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আদালতপাড়ায় যাচ্ছি হাজিরা দিতে হচ্ছে, আমাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে। সরকারি জুলুম এবং আদালতের মাধ্যমে জুলুম হচ্ছে। আইন ও আদালতের ওপর শ্রদ্ধা রেখে আমরা নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছি, এভাবেই আমরা ফেস করছি। তারা মিথ্যে মামলা দিয়েছে এবং বিচারকও তাদের। ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে আমরা মোকাবিলা করছি।’

মামলা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবসময়ই ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যেহেতু গণবিরোধী সরকার এবং অনির্বাচিত সরকার সুতরাং ভয় পাচ্ছে। মানুষের উপস্থিতি মানুষের সমাগম এজন্য রাষ্ট্রশক্তি দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে, তারপরও সমস্ত কিছু ভেদ করে জনগণ জমায়েত হচ্ছে। এভাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসব মামলা দেওয়া হচ্ছে ভয় পাওয়ার জন্য, যাতে নেতাকর্মীরা মাঠে না নামে।’ এ সময় তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে।

দলটির আরেকজন যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে পাঁচশোর উপরে মামলা, প্রতিদিন ৫-৮টি মামলার হাজিরা দিতে হয়। আমার পক্ষে এতগুলো মামলার হাজিরা প্রতিদিন দেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। অনেক দিন একই সময় একাধিক মামলার হাজিরা দিতে হয়, এটা খুব কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জন্য রাজনীতি করা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিএনপি নেতা কর্মীদের কোর্ট আদালতে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন  বিরাজনীতিকরণ চলছে, পাশাপাশি দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। আওয়ামী লীগ একটি পুরাতন রাজনৈতিক দল আমরা তাদের কাছে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করি না।’

সোহেল বলেন, ‘বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছেন। এতকিছুর মধ্যেও বিএনপি তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ স্বৈরাচারমুক্ত করতে হলে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হলে যত সমস্যা আসুক সেগুলো যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে না পারি তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ হবে। একটি দায়িত্বশীল দল হিসেবে বিএনপি তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মামলা হামলা উপেক্ষা করেও চেষ্টা করছি আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে।’

এমই/জেবি