নিজস্ব প্রতিবেদক
০১ নভেম্বর ২০২৩, ১০:১৩ পিএম
সারাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনও কেটেছে সহিংসতা ও নাশকতার মধ্য দিয়ে। অবরোধের দ্বিতীয় দিন বুধবার (১ নভেম্বর) দিনভর সারাদেশ থেকে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় শেষ হচ্ছে টানা তিন দিনের এই কর্মসূচি।
তবে আগামী রোববার থেকে আবারও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।
দীর্ঘদিন পর রাজনৈতিক কর্মসূচি সহিংস রূপ নেওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। অবরোধের প্রভাবে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। অবরোধ উপেক্ষা করে মালিকরা গণপরিবহন চালানোর ঘোষণা দিলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত যাত্রী। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছে না। রাজধানীতে যান চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও দূরপাল্লার বাস ছাড়ছে না। কোনো কোনো কোম্পানি বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও যাত্রীর অভাবে তারাও বাস চালানো থেকে বিরত থাকছে। ট্রেন যথাসময়ে ছেড়ে যাচ্ছে।
তবে কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে বুধবার পেট্রোল বোমা ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ট্রেনযাত্রীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। লঞ্চ চলাচল অব্যাহত থাকলেও যাত্রী সংকট রয়েছে।
এদিকে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বুধবার (১ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি যখন এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা তখন নতুন করে রাজনৈতিক সহিংস কর্মসূচি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একদিন হরতাল-অবরোধে দেশের সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় জানিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
দ্বিতীয় দিনে যত নাশকতা
সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বুধবার ঢাকার তিনটি স্থানে বাসে আগুন দেওয়া ছাড়াও চট্টগ্রামে কয়েকটি বাস ও ট্রাকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বুধবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল-সংলগ্ন এলাকার রাস্তায় মিডলাইন পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আল আমিন (২০) একজনকে আটক করেছে পুলিশ। মুগদা এলাকা থেকে ধাওয়া করে তাকে আটক করা হয়। পরে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে স্থানীয়রা।
পরে সংশ্লিষ্ট গাড়ির স্টাফরা জানান, আরামবাগ এলাকা থেকে যাত্রীবেশে তিন যুবক গাড়িতে উঠেছিলেন। পরে মুগদা এলাকায় পৌঁছালে তাদের মধ্যে থেকে একজন বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। ওই সময় পালিয়ে যাওয়ার সময় ধাওয়া করে আল আমিনকে আটক করেন বাসের স্টাফ ও স্থানীয়রা।
এদিকে, বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে আরও দুইটি বাসে অগ্নিসংযোগের খবর মিলেছে। এরমধ্যে শ্যামলীতে সাভার থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ওয়েলকাম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। গাবতলীমুখী ওই বাসটি শ্যামলী সিনেমা হল অতিক্রম করছিল। ওই সময় হঠাৎ বাসটির পেছন দিকে আগুন দেখা যায়। একপর্যায়ে স্থানীয়রা মিলে আগুন নেভান। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে তাদের শনাক্ত বা আটক করা যায়নি।
অন্যদিকে, সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রগতি সারণীর নতুন বাজারে বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর আগে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বুধবার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ভেল্লাপাড়া ব্রিজ এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহির হোসেন জানান, সকালে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নামিয়ে দিয়ে বাসটি কর্ণফুলী থেকে পটিয়ার দিকে যাচ্ছিল। সামনে অবরোধকারীদের দেখে বাসটি ফিরে আসার চেষ্টা করে। এ সময় অবরোধকারীরা বাসটি আটকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে ঘটনায় জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রামের এ ঘটনার আগে বুধবার ভোরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও দূরপাল্লার একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের বলিয়ারপুর এলাকার মধুমতি মডেল টাউনের সামনে ঢাকা-গাইবান্ধা রুটে চলাচলকারী রিমি পরিবহনের বাসটি মহাসড়কের পাশে রাখা ছিল। পরে আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
দ্বিতীয় দিনে এমন অগ্নিসংযোগের ঘটনার পাশাপাশি সিলেট এবং বগুড়ায় অবরোধকারীদের সাথে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মহাসড়কের ওপর টায়ারে আগুন ধরিয়ে অবরোধ কিংবা রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধের মতো ঘটনার খবরও মিলেছে। তবে অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে কোথাও কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
প্রথম দিন যা ঘটেছিল
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিনে মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সারাদেশে অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে যানবাহনে আগুন, পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষ এবং পুলিশকে কোপানোর ঘটনাও ঘটেছে।
মঙ্গলবার সকালে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ছয়সুতি এলাকায় অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় দুইজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- ছয়সুতি ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি মোহাম্মদ বিল্লাল মিয়া এবং একই ইউনিয়নের ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মো. রেফায়েত উল্লাহ তনয়।
একই দিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি, অবরোধকারীরা ওই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করেছে। পরে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।
এদিকে, সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ওইদিন বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়াও একই দিনে মিরপুর, বিজয়নগর ও মাতুয়াইল এলাকায় যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। আবার আরকে মিশন রোড এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় অবরোধকারীরা।
অন্যদিকে, অবরোধের প্রথম দিনে গাজীপুরে বাসে আগুন দেওয়ার খবর মিলেছে। একই ঘটনা ঘটেছে সিলেটেও। পাশাপাশি সেখানে বাস ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড, খুলশী ও বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। তবে এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জেবি/আইএইচ