images

রাজনীতি

কেমন হবে অবরোধ কর্মসূচি, কতটা প্রভাব ফেলবে জনজীবনে

নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৩৭ পিএম

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর দলটি কঠোর কর্মসূচি দেওয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে এক দিন দেশব্যাপী হরতাল পালনের পর টানা তিন দিন দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) ভোর থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি চলবে বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী এবং ১২ দলীয় জোটসহ আরও কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলও অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

অনেক বছর পর হরতাল-অবরোধের রাজনীতিতে ফিরেছে দেশ। রাজনীতির মাঠ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠায় জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। হরতাল ডেকে তা পালনে বিএনপিকে মাঠে তেমন সক্রিয় দেখা না গেলেও জনজীবনে এর প্রভাব পড়ে। এবার টানা তিন দিনের অবরোধ জনজীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে নতুন করে উদ্বিগ্ন দেশবাসী। অনেকের জিজ্ঞাসা অবরোধ কী হবে? হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্য কী?

কেমন হবে অবরোধ কর্মসূচি?

রোববার (২৯ অক্টোবর) হরতাল শেষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশে চলমান বিচারহীনতা, অপশাসন, সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচার, অর্থপাচার ও সিন্ডিকেটবাজির ফলে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহতি ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার স্বার্থে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষে ২৮ অক্টোবর আয়োজিত মহাসমাবেশে হামলা করা হয়। এছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ আন্দোলনরত বিভিন্ন দলের সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ এবং এক দফা আদায়ে ৩১ অক্টোবর এবং ১ ও ২ নভেম্বর তিন দিন অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করছি।

তবে এর আওতা হরতালের মতোই হবে নাকি শুধু জাতীয় মহাসড়ক এবং রেল ও নৌ-বন্দরকেন্দ্রিক হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে পরে রিজভী আহমেদ বিবিসিকে জানিয়েছেন, অবরোধ বলতে তারা সারা বাংলাদেশে সবধরনের চলাচল বন্ধ করাকেই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অবরোধ কর্মসূচি মানে সর্বাত্মক অবরোধ। রাস্তা-ঘাট, রেল, নৌ সব বন্ধ থাকবে। এমনকি শহরের ভেতরেও সব ধরনের চলাচল বন্ধ থাকবে।’

Obo2

বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সংবাদপত্রের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন ও জরুরি ওষুধ পরিবহন সেবা অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে।

অবশ্য বিএনপির জন্য অবরোধ কর্মসূচি নতুন নয়। এর আগেও দলটি একটানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সেটি এখন থেকে আট বছরেরও বেশি আগে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ পালন করে দলটি৷

সে সময় মূলত অবরোধের ঘোষণা দেওয়ার পর এক পর্যায়ে এর সঙ্গে হরতালকেও যুক্ত করে দলটি। ওই হরতাল-অবরোধ এক পর্যায়ে সহিংস রূপ নেয়। একের পর এক বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

সরকার এসব ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করলেও তারা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো সরকারকেই এর জন্য দায়ী করে আসছে। তখন একটানা হরতাল অবরোধ চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। রাজপথেও অবরোধের সমর্থনে বিএনপি কিংবা বিশদলীয় জোটের নেতাকর্মীদের আর দেখা যায়নি।

এক পর্যায়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নিজেরাই সেই কর্মসূচি স্থগিত করে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ যুগপৎ কর্মসূচির অবসান ঘটান। এর মাধ্যমেই বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি শেষ হয়। এরপর দলটি আর অবরোধের কর্মসূচিতে যায়নি।

কী প্রভাব পড়বে জনজীবনে

অবরোধে জনজীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। তবে হরতাল-অবরোধে দলীয় নেতাকর্মীরা সক্রিয় না থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রভাব পড়ে। নাশকতার আশঙ্কায় জনসাধারণের চলাচল ব্যাহত হয়। যদিও অবরোধ ঠেকাতে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে সরকারি দল। তবে এত জনমনে আতঙ্ক আরও বাড়ে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকলে নাশকতার আশঙ্কা প্রকট হয় বলে মন্তব্য তাদের।

এদিকে অবরোধে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সোমবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মালিক-শ্রমিকদের যৌথসভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়। পরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান। অবরোধের দিনগুলোতে গাড়ি চলাচলে যাতে কোনো প্রকার বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য ঢাকাসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অবরোধ কর্মসূচিতে র‌্যাবের স্পেশাল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবে। জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষা করতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

Obo3

সোমবার (৩০ অক্টোবর) রাতে এক ক্ষুদে বার্তায় র‌্যাবের মিডিয়া বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাব ফোর্সেসের ১৫টি ব্যাটালিয়নের তিন শতাধিক টহল নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম চলমান থাকবে। কেউ কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতার পরিকল্পনা করলে তাকে সাথে সাথে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। যেকোনো উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় র‌্যাবের স্পেশাল টিম ও স্টাইকিং ফোর্স রিজার্ভ রাখা হয়েছে। যেকোনো নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে র‌্যাব সার্বক্ষণিক দেশব্যাপী নিয়োজিত থাকবে।

অবরোধকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে।

সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে, ঠিক এর মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার কর্মসূচি। হরতালের আগের দিন (২৭ অক্টোবর) যেখানে বাজারে দেশি পেঁয়াজের মূল্য ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা, সেটি দুই দিনের মাথায় বেড়ে হয়েয়ে ১৩০ টাকা। ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গোল আলু যেখানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ছিল সেটি আজকের বাজারে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। প্রতিটি তরকারি দাম ১০০ টাকার ওপর।

আগামীকাল থেকে তিন দিনের জন্য অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। এই সুযোগে অসৎ মজুদদার, কালোবাজারি ও সিন্ডিকেটকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। বাজারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যেতে পারে বাজার। এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ভোক্তা অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ টাস্ক গঠন করে ২৪ ঘণ্টা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অন্যথায় বাজার স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব না হলে জনগণের দুর্ভোগ আরও চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।

জেবি