কাজী রফিক
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম
উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে সামনের সারির নেতা হওয়ার ঘটনা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। শুধু পদ-পদবি নয়, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ারও অসংখ্য উদাহরণ আছে দেশের রাজনীতিতে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সংসদ সদস্যের সংখ্যাও অনেক। যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বর্তমান ও প্রয়াত প্রবীণ নেতাদের সন্তান, স্ত্রী, ভাই, বোন রয়েছেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারাসহ সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন দলগুলোতেও এমন সংসদ সদস্য আছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নতুন করে তাদের সন্তানদের সামনে আনার চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগে বড় পদে না থাকলেও একাধিকবারের নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হওয়া সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ পরবর্তী প্রজন্মকে নিজ আসনের কান্ডারি বানাতে চাইছেন।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের প্রচার-প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে নিজ নিজ আসনে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নৌকার প্রার্থী হিসেবে লড়তে নিজেদের প্রস্তুত করতে তৃণমূলে সময় দিচ্ছেন এসব নেতাদের সন্তানরা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে সামনের নির্বাচনে সামনে দেখা যেতে পারে— এমন গুঞ্জন আছে দলের ভেতরে-বাইরে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন নীরবে-নিভৃতে কাজ করা মেয়েকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে দেখা গেছে তাকে।
ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে, দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করে শেখ হাসিনা মেয়েকে সামনে নিয়ে আসছেন।
অবশ্য এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার কিংবা আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। যদিও নিজের বয়সের কথা বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনা একাধিকবার দলের দায়িত্ব অন্যদের হাতে তুলে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন।
অবশ্য পরবর্তী প্রজন্মকে সামনে আনায় দোষের কিছু দেখছেন না আওয়ামী লীগ নেতারা। সন্তান হিসেবে নয়, যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই তারা নেতৃত্বে আসবেন— এমন প্রত্যাশা আওয়ামী লীগ নেতাদের।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম ঢাকা মেইলকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যারা এমপি ছিলেন, জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তারা অনেকেরই বয়সের কারণে, নানাবিধ কারণে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতেই পারেন। এটা তো দোষের কিছু না। অনেকেই নতুন ফুল ফোটানোর চেষ্টা করছেন। ছেলে হোক, মেয়ে হোক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভেতর থেকে হচ্ছে। এটা হতে পারে। তবে তাদের দলের নেতাকর্মী হতে হবে। দলের আদর্শের কর্মী হতে হবে ।
বর্তমান সংসদেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্বজনদের মধ্যে একাধিক সংসদ সদস্য আছেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে।
গুঞ্জন আছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম নিজের পাশাপাশি সন্তানদেরও প্রার্থী করতে পারেন। ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাঈমও ভোটে লড়তে পারেন— এমন আলোচনা আছে।
ফজলে ফাহিম ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। একই সঙ্গে তিনি যুবলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য। তার ছোট ভাই শেখ ফজলে নাঈম যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনে তার প্রার্থী হওয়ার আলোচনা আছে। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। যিনি শেখ পরিবারের আরেক সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের ছেড়ে দেওয়া আসনে ভোটে জিতেছেন।
বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যানির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ছেলে সেরনিয়াবাত আশিক আব্দুল্লাহ ভোটে লড়তে পারেন— এমন আলোচনা আছে। কোনো কারণে বাবা ভোটে না লড়লে ছেলেকে প্রার্থী করা হতে পারে। অন্যদিকে বরিশাল-৫ আসনে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে সাবেক মেয়র ও বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে প্রার্থী করার চিন্তাও আছে বর্ষিয়ান এই রাজনীতিকের।
এদিকে দেশের ২৫তম রাষ্ট্রপতি মোঃ শাহাবুদ্দিনের ছেলেও সামনের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাবনা-৫ (সদর) আসনে নৌকার প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতিপুত্র আরশাদ আদনান রনি জানিয়েছেন, বাবার সম্মতি ও ইচ্ছাতেই তিনি নির্বাচনের মাঠে এসেছেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বর্তমান ও প্রয়াত প্রবীণ নেতাদের সন্তানের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে সংসদে আছেন তারাও আগামীতে লড়বেন বলে জানা গেছে। প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় সামনেও লড়বেন। তার দাদা ছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। আওয়ামী লীগের থিংক ট্যাংক-খ্যাত প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। সামনেও ভোটের মাঠে থাকবেন তা অনেকটা নিশ্চিত।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিকও ভোটে লড়বেন।
এদিকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক আসনেও আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের সন্তানদের সামনে আনার চেষ্টা করছেন। ঢাকা-৭ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম প্রভাব ধরে রাখতে ছেলে সোলায়মান সেলিমকে সামনে আনছেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আসনটিতে আওয়ামী লীগের একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও বর্তমান সংসদ সদস্য নিজের সন্তানকে সামনে নিয়ে আসতে চান। কারণ শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাজী মো. সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না এটা নিশ্চিত।
ছেলে সোলায়মান সেলিম তাই বাবার আসনে নিজেকে যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে প্রচার-প্রচারণা ও দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। অবশ্য এই আসনের অন্য নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ভাষ্য ভিন্ন। পরিবারের বাইরে গিয়ে কাউকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি কর্মীদের।
একইভাবে ঢাকা-১১ আসনেও নিজ সন্তানকে সামনে নিয়ে আসতে চান আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ। জানা গেছে, এ কে এম রহমতুল্লাহর ছেলে হেদায়েত উল্লাহ রন রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন।
ঢাকা মেইলকে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেন, আমার বয়স হয়েছে। আমি আর নির্বাচন করব না। আমার ছেলে করবে। সে ফ্রান্সে আছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে আসবে।
শিল্পপতি হেদায়েত উল্লাহ রন ইতিমধ্যে বাবার আসনে দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় হয়েছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও নিয়মিত জনসংযোগ করছেন। পুরো এলাকায় বাবা-ছেলের ব্যানার ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। গত এপ্রিলে সপরিবারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন এ কে এম রহমতুল্লাহ।
অবশ্য সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ তার জায়গায় ছেলেকে দাঁড় করাতে চাইলেও অনেকেই এর পক্ষে নন। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাবি, রহমতুল্লাহর ছেলের চাইতে আসনটিতে আরও যোগ্য প্রার্থী আছেন। হেদায়েত উল্লাহকে মনোনয়ন দেয়া হলে এর বিরুদ্ধাচারণের সম্ভাবনাও রয়েছে।
কারই/জেএম