বোরহান উদ্দিন
০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৫১ এএম
পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বেশ জনপ্রিয় স্লোগান ‘খেলা হবে’। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এটি বেশ সাড়া ফেলেছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে বিরোধী দল কিংবা অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও মাঝেমধ্যে শোনা যায় ‘খেলা হবে’ স্লোগান। বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা অবশ্য এটাকে ভালোভাবে নেননি। তবে তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই শব্দ দুটি শোনা যায় নেতাদের মুখ থেকে। তবে গত কয়েক দিন ধরে ‘খেলা হবে’ স্লোগান পেছনে ফেলে সামনে এসেছে ক্রিকেট খেলার নানা মারপ্যাঁচের কথা।
রাজনীতিবিদদের কেউ বলছেন- ক্রিকেটের বেশ কঠিন বিষয় ‘গুগলি’ বল করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে ‘আউট’ করে দেবেন। কেউ আবার পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গুগলি নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই বলে দাবি করছেন। কারণ এই দলের নেতাদের দাবি, গুগলি হলেও প্রতিপক্ষ দল ‘নো’ বল করছে। ফলে আউট হওয়ার সুযোগই নেই।
ক্রিকেট মাঠের এমন সব কঠিন কঠিন কথাগুলো যখন রাজনীতিবিদরা একের পর এক বলছেন তখন সাধারণ মানুষও বেশ উপভোগ করছেন। অনেকে আবার এসব নিয়ে হাস্যরস করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিয়ে নানা কথাবার্তাও লিখছেন কেউ কেউ।তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিবিদরা নানা বিষয় ধরে কথা বললেও মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতে বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজনীতি এটা খেলা নয়। রাজনীতিবিদরা অনেকটা বল প্রয়োগ করার জন্য এসব বলছেন। এগুলো অর্বাচীন কথাবার্তা। মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলা উচিত তাদের। কারণ এগুলো খেলা কিংবা তামাশার বিষয় না। এটা সিরিয়াস ইস্যু।’
রাজনীতির মাঠে যেভাবে এলো ক্রিকেটের আলাপ
রাজনীতির মাঠে ‘খেলা হবে’ এই বক্তব্য কিছুটা নীরব হয়ে আসার মধ্যেই আবার সামনে নিয়ে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর। গত ৩১ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ক্রিকেট খেলা দেখেন? আমাদের সাকিব খুব ভালো ব্যাটসম্যান। তিনি কিন্তু আবার স্পিন বলও করেন। স্পিন বলের আরেকটা রূপ আছে গুগলি। আজকে বিএনপির গুগলিতে আওয়ামী লীগ পুরো বোল্ড আউট হয়ে গেছে। গুগলিতে ব্যাটসম্যান যেমন কিছু বুঝে ওঠার আগে আউট হয়ে যায়, বিএনপির দুই দিনের কর্মসূচিতে (২৮ ও ২৯ জুলাই) আওয়ামী লীগের একই অবস্থা হয়েছে।’
তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমেও বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। পরে ক্রিকেটীয় ভাষায় পাল্টা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গত ১ আগস্ট রংপুরে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য টেনে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে আউট করতে গিয়ে নিজেই বোল্ড আউট হয়ে গেছে বিএনপি। তারা ঢাকা অবরোধ করতে চেয়েছিল, পরে নিজেরাই পালিয়ে গেছে।’পরে আবার শুক্রবার (৪ আগস্ট) নয়াপল্টনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে মির্জা ফখরুল ‘খেলা হবে’ প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন না করে ক্ষমতায় যেতে পারলে কী আনন্দ, তাই না! খুব তো বলেছিলা খেলতে চাও, তাহলে ক্ষমতা ছেড়ে রাস্তায় আসো।’
এবার আবার এটা নিয়ে সরব হলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শনিবার (৫ আগস্ট) এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন আওয়ামী লীগকে গুগলি মেরে বোল্ড আউট করে ফেলেছে। গুগলি তো করেছেন, কিন্তু বলতো নো বল। নো বলে গুগলিও হবে না, বোল্ড আউটও হবে না।’
এখানেই শেষ হয়নি ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতিবিদদের আলোচনা। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পেরুতেই এ নিয়ে পাল্টা কথা বলেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক অনুষ্ঠানে তিনি সরকারকে অন্যভাবে আউট করার কথা বলেন।
রিজভী বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের বলেছেন- নো বল করে সরকারকে আউট করা যাবে না। কিন্তু আমরা আপনাদেরকে নো বলে কিংবা এলবিডব্লিউ দিয়ে আউট করব না। বরং মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে পতন ঘটানো হবে।’
যেভাবে আসে ‘খেলা হবে’ স্লোগান
ভারতের বড় বড় রাজনীতিবিদদের মুখে ‘খেলা হবে’ স্লোগান শোনা গেলেও এটির উৎপত্তি মূলত নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। ২০১৩-১৪ সালের দিকে নিজ এলাকায় নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান একটি রাজনৈতিক সভায় বলেছিলেন, ‘কারে খেলা শেখান? আমরা তো ছোটবেলার খেলোয়াড়। খেলা হবে!’ এরপর থেকে ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এটাকে নিজেদের নির্বাচনী স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করে। দলের তরুণ নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য ‘খেলা হবে’ স্লোগান নিয়ে একটি গান বানান, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
এদিকে গত বছরের ১৬ জুলাই রাজধানীতে একটি দলীয় কর্মসূচিতে এই স্লোগানটি ব্যবহার করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মুহূর্তে যা ভাইরাল হয়ে যায়। ‘খেলা হবে’ বলে স্লোগান শোনা গেছে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার কণ্ঠেও।
ওই সময় বিএনপি মহাসচিবও খেলা হবে নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য ছিল, ‘কে কোথায় কী বলল না বলল, তাতে কান দেওয়ার দরকার নেই। কে খেলা বলছে না কী বলছে, বলতে দিন। আমরা আমাদের মতো অটল থাকব।’অবশ্য এই স্লোগান নিয়ে সমালোচনা হয়েছে খোদ সংসদেও। সংসদে এই স্লোগানের সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। পরে এর উত্তরও দেন ওবায়দুল কাদের।
তবে ওই বছরের ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ‘খেলা হবে’ এর ব্যাখ্যা দিয়ে কাদের বলেন, ‘এটা একটা পলিটিক্যাল হিউমার। ফুল বেচে যে বাচ্চাটি, সে আমার গাড়ি দেখেই বলে, ‘খেলা হবে। এটা মানুষ অ্যাকসেপ্ট (গ্রহণ) করে ফেলেছে।’
অবশ্য তার দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ তখনই এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘হয়তো কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারেন, আমার বিবেক বলে, এই স্লোগানটা এইভাবে না দেওয়া উচিত। এটা রাজনৈতিক স্লোগান না।’তবে ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই স্লোগানটি দিলেও এ ব্যাপারে সরকারপ্রধানকে কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি।
‘খেলা হবে’- এই জাতীয় স্লোগান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘খেলা হবের মতো কথা বলে রাজনীতিবিদরা হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছেন। রাজনীতিতে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ এটা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশ সংঘাতের দিকে যেতে পারে।’
বিইউ/জেবি