ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৯ মে ২০২৩, ১০:৫৪ এএম
গেল ৮ মে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় একটি লঘুচাপ। পরে এটি আরও ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয়। ক্রমান্বয়ে আরও ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপ থেকে হয় সুস্পষ্ট নিম্নচাপ। এরপর ১১ মে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড়টি। নাম দেয়া হয় ‘মোখা’। আর এই নামকরণ করে ইয়েমেন।
শুরু থেকে বলা হচ্ছিল, এটি সুপার সাইক্লোনে রূপ নিতে পারে। আর ‘মোখা’ অতিক্রম করবে বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল ও মিয়ানমারের উত্তর উপকূল দিয়ে। বাংলাদেশ অংশে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়, সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ। এতে সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সেন্টমার্টিন থেকে প্রায় অর্ধেক মানুষ চলে আসেন টেকনাফে।
‘মোখা’র সংবাদ কাভার করতে আমি মো. বোরহানুল আশেকীন এবং ক্যামেরাপারসন তুষার লস্কর কক্সবাজার পৌঁছাই ১২ মে শুক্রবার ভোরে। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি আজিম নিহাদের সহায়তায় যাই, ঘূর্ণিঝড়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা শাহপরীর দ্বীপে। প্রথমে আমি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি আশ্রয়কেন্দ্রের কী অবস্থা, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি প্রস্তত কিনা? কারণ ঘূর্ণিঝড় শুরু হলে স্থানীয়রা সাইক্লোন শেল্টারেই আশ্রয় নেবেন।
দেখা যায়, তখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। সেখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা। যদিও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তা অত্যন্ত মজবুত ও নতুন।
১২ তারিখে কক্সবাজারে জারি করা হয়, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র আর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তোলা হয় লাল পতাকা। পরদিন ১৩ মে আমি আবারও খোঁজ নিয়ে দেখি যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তখনও প্রস্তুত নয়। ১৩ মে সকাল থেকে শুরু হয় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর থেমে থেমে বয়ে যায় বাতাস। এমন অবস্থার মধ্যে শাহপরীর দ্বীপে ও পশ্চিমপাড়া শাহপরীর দ্বীপে দুপুরের পর বেশ কয়েকজন নারী-শিশু চলে আসে সেই আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে সন্ধ্যার পর তারা চলে যান। কারণ হিসেবে বলেন, ‘এখানে পানি পানের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাথরুমে যাবার সুবিধা নেই’।
এর পাশেই আরেকটি আশ্রয়কেন্দ্র। স্বেচ্ছাসেবকরা বারবার মাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন, আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য কিন্তু একজনও সেখানে আসেননি। ১৩ তারিখ রাতে আমি, আমার ক্যামেরাপারসন ও ড্রাইভার মিলে সেই আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। তিন তলা আশ্রয়কেন্দ্রে সেদিন কেউ আসেননি।
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত থাকার পরও স্থানীয়রা কেন আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন না, সেটি খুঁজতে কথা বলি বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে। তারা জানায়, শাহপরীর দ্বীপ, সমুদ্র আর নাফ নদীর তীরেই তাদের জন্ম। দাবি করেন, কখন ঝড় আসবে আর কখন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে তারা জানেন। তাই স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক করার পরও তারা ওই মুহূর্তে আশ্রয় কেন্দ্রে যাননি।
এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে তাদের ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু চুরির আশঙ্কার কথা জানান অনেকে। এই ভয়ে তারা শুরুতে আশ্রয়কেন্দ্রে যান না। আবার আগেভাগে সাইক্লোন শেল্টারে গেলে থাকার পরিবেশ পাওয়া যায় না। পানি পানের সুব্যবস্থা ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও থাকে না বলে দাবি তাদের।
তরুণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক তথ্য আসছে না। বলেন, প্রায় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম করছে, একেক জায়গায় একেক রকম তথ্য আসছে। কখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত করবে সে বিষয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মূলধারার গণমাধ্যম আর আবহাওয়া অধিদফতর থেকে।
অবশেষে ১৪ মে দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র তাণ্ডব। প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়ে যায় শাহপরীর দ্বীপে। চলে টানা বৃষ্টি। যখন প্রচণ্ড বেগে ঝড় শুরু হয়, তখনই আশ্রয়কেন্দ্রে আসা শুরু করেন স্থানীয়রা। বাতাসের কারণে গাছ ভেঙে পড়ছে, গাছ উপড়ে যাচ্ছে, ঘরবাড়ি মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নিজের শিশু সন্তানদের বুকে জড়িয়ে সবাই দৌড়ে আসছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। ৫ ঘণ্টা পর ‘মোখা’র তাণ্ডব কমে গেলে সবাই আবার আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেন।
১৪ তারিখ ঝড় চলাকালীন আমরা জানতে পারি, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা তিনজন, টেকনাফ থেকে স্পিডবোটে দ্বীপটির উদ্দেশে রওনা করি। স্থানীয় ৫ জন আর আমরা তিনজন, এই আটজনই ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রথম সেন্টমার্টিনে আসি। এখানে পৌঁছাতে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ খানিকটা ভীতি জাগায় আমাদের মনে।
সেন্টমার্টিন পৌঁছার পর আমি দ্বীপটির প্রায় অর্ধেক অংশ ঘুরে দেখি। দেখা যায়, সব জায়গায় ‘মোখা’ তার ক্ষতচিহৃ রেখে গেছে। এখানে থাকা ৭শ কাচা ঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, ৩শ এর বেশি আধাপাকা ঘর আর ১শ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঝড় শুরুর পর সবাই প্রার্থনা করেছেন দ্বীপটির জন্য, দ্বীপে থাকা মানুষের জন্য। বিধ্বস্ত এই জনপদে এখন দরকার মানবিক সহায়তা। একই সাথে সহায়তা দরকার শাহপরীর দ্বীপে।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল 24