images

মতামত

কর্তৃত্ব হারাচ্ছে মার্কিন ডলার

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১৩ মে ২০২৩, ০৮:১০ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য দিয়ে লেখাটি শুরু করছি- Our Currency is crashing and will soon no longer be the world standard which will be our greatest defeat in the history of the US in the last 200 years.

মার্কিন ডলার বা USD

মার্কিন ডলার বা USD হলো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মুদ্রা। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক ও জনপ্রিয় মুদ্রা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মুদ্রার ISO কোড হলো USD যার সংক্ষিপ্ত রূপ US$. USD হলো বিশ্বের রিজার্ভ কারেন্সি এবং আর্ন্তজাতিক লেনদেনে সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা। USD’র মান বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে পরিমাপ করা হয়। যেমন- BDT/USD অর্থাৎ ১ মার্কিন ডলার সমান বাংলাদেশি মুদ্রায় কত টাকা।

মার্কিন ডলারের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তবে ব্রেটন উডস চুক্তির ফলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর মার্কিন ডলার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মুদ্রা হিসেবে অবির্ভূত হয়। মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা ধরা হয়। Global Reserve currency বা একটি রিজার্ভ মুদ্রা একটি বৈদেশিক মুদ্রা যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক কর্তৃপক্ষ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করে। রিজার্ভ মুদ্রা আন্তর্জাতিক লেনদেন, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং বিশ্ব অর্থনীতির সবদিকে ব্যবহার করা যায়। এটি একটি হার্ড বা সেফ-হেভেন কারেন্সি হিসেবে পরিচিত।

ব্রেটন উডস চুক্তি

১৯৪৪ সালে ৪৪টি মিত্র দেশের ৭৩০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের মূল এজেন্ডা ছিল ‘স্বর্ণের মানের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার সৃষ্টি করা’। এ লক্ষ্যে ৪৪টি দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তিকেই ব্রেটন উডস চুক্তি বলা হয়।

ব্রেটন উডস চুক্তি ছিল একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা চুক্তি যার মাধ্যমে মুদ্রার বিনিময় হারকে মানসম্মত করা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করা এবং স্বর্ণের দামের বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হতো।

ব্রেটন উডস চুক্তির কার্যকারিতা

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব অর্থনীতি খুবই নড়বড়ে ছিল এবং মিত্র দেশগুলো মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তা থেকে উত্তরণে এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সম্ভাব্য সুবিধা ও মুনাফাকে সর্বাধিক করার লক্ষ্যে ব্রেটন উডস চুক্তি ও ব্রেটন উডস সিস্টেম প্রবর্তন করা হয়। চুক্তিটি তখন বিশ্বের ৪৪টি দেশকে একত্রিত করেছিল, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সমাধানে মিত্র দেশগুলোকে একত্রিত করেছিল। চুক্তিটি সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে। ১৯৪৪ সালের জুনে ব্রেটন উডস চুক্তিতে স্বাক্ষরিত হয়। যার ফলে, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং মুদ্রা বিনিময় হারের বিপরীতে স্বর্ণের দামের মানসম্মত মানদণ্ড সৃষ্টি এবং প্রচলন হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক উন্নতি সাধিত হয়।

মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে

বর্তমানে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে যা দিনের আলোর মত স্বচ্ছ। মার্কিন ডলারের ইতিহাসে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ৪ বার বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে-

১। ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতন,

২। ইউরোপের একক মুদ্রা Euro প্রচলন,

৩। ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, এবং

৪। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক/বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতন

ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার ফলে সামগ্রিক বিশ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সর্বাধিক মুনাফা করতে সক্ষম হয়, একটি স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব অর্থনীতি পুনর্গঠন হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও মিত্র দেশগুলোর সমন্বয়হীনতা, ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ ধরে রাখতে না পারা এবং মার্কিন ডলারের অতি মূল্যায়নের কারণে চুক্তির ২৫ বছরের মাথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ড রিচার্ড নিক্সন ‘মার্কিন ডলারকে স্বর্ণের দামে রূপান্তর করার ক্ষমতা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো’ মর্মে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চুক্তিটিকে স্থগিত করেন।

এটিকে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার প্রথম কারণ হিসেবে দেখা হয়। ১৯৭৩ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী মুদ্রার বিনিময় হার ভাসমান পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারণ (Floating Exchange Rate) শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করত ৮০.৩০% এবং অন্যান্য মুদ্রায় সংরক্ষণ করত ১৯.৭০%। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্রেটন উডস চুক্তি স্থগিত এবং ভাসমান বিনিময় হার প্রচলনের সাথে সাথে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রায় রিজার্ভ রাখতে শুরু করে।

ইউরোপের একক মুদ্রা Euro প্রচলন

১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারিতে ইউরোপের একক মুদ্রা Euro প্রচলন হওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব মুদ্রা বাজারে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব দ্বিতীয়বারের মতো হুমকির সম্মুখীন হয়।

দুটি মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে ইউরোকে বাজার-চালিত প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়।

প্রথমত, ইউরো বাজার-চালিত প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়েছে বিধায় এটি একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ‘ইউরো’ মুদ্রা বাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে। অর্থাৎ বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি ‘ইউরো’কে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে রিজার্ভ রাখতে শুরু করে।

দ্বিতীয়ত, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ছিল ইউরো প্রচলনের দ্বিতীয় মূল কারণ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মুদ্রার পূর্বশর্ত হলো উক্ত মুদ্রার মুল্য স্থিতিশীলতা। সময়ের সাথে সাথে ইউরোর মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। ২০০২ সালে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউরোর শতকরা হার ছিল ২৩.৬৫ আর মার্কিন ডলার ছিল ৬৬.৫০ শতাংশ, যা ২০০১ সালে ছিল ৭১.৫১ শতাংশ। অর্থাৎ ইউরো প্রচলন হওয়ার ২ বছরের মধ্যে বিশ্ব রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে খ্যাত মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব ৫ শতাংশ কমে যায়।

২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা

বিশ্বব্যাপী জাতীয় অর্থনীতিতে মন্দার সময়কাল ধরা হয় ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এই অর্থনৈতিক মন্দার তীব্রতা বা সময়কালে দেশে দেশে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সংগঠিত অর্থনৈতিক মহামন্দার পর এটি ২য় সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক মন্দা যাতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা বিনিময় হার ও রিজার্ভ মুদ্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। যার ফলে ২০০৯ সালে মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক রিজার্ভ ৬৬.৫০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৬২.০৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই অর্থনৈতিক মন্দার ফলে অন্যান্য রিজার্ভ মুদ্রার তুলনায় মার্কিন ডলারে বৈশ্বিক রিজার্ভ হ্রাস পায়।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা

বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নতুনভাবে ডি-ডলারাইজেশন শুরু হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধের আগে থেকে ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো দেশই সব ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। ফলে প্রত্যেক দেশকেই অন্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা আমদানি করতে হয়। নিষেধাজ্ঞার ফলে উক্ত দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য মার্কিন ডলারে পরিশোধ করা যাবে না বিধায় বিকল্প মুদ্রার মাধ্যমে পণ্য/সেবার আমদানি-রফতানি মূল্য পরিশোধ করছে।

চীন ও রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে ইরান মার্কিন ডলার পুরোপুরি ত্যাগ করেছে। ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন মুদ্রা চালু করার কথা ভাবছে। আমেরিকা ও ইউরোপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একমাত্র ‘বৈশ্বিক আর্থিক বার্তা প্রেরণ ব্যবস্থা বা SWIFT’ ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়ার পর রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য নিষ্পত্তির জন্য চীন ও ভারত তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করছে।

শেষ কথা

বৈশ্বিক বাজারে মার্কিন ডলারের আধিপত্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে মার্কিন ডলারে রাখা রির্জাভের অংশ ১৯৯৯ সালে ছিল ৭১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে হ্রাস পেয়ে হয় ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত ২৩ বছরে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ১৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

বিস্ময়কর বিষয় হলো বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ান গত ৮ বছরে দৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করেছে। চীনা মুদ্রা ইউয়ান বর্তমানে ২.৭ শতাংশ হলেও রিজার্ভ হিসেবে ইউয়ান বৃদ্ধি পাওয়ার গতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাই হোক, ডি-ডলারাইজেশন সহজ প্রক্রিয়া নয়। মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে যে কোনো মুদ্রার জন্য অনেক বছর সময় লাগবে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে বিশ্বে ডি-ডলারাইজেশন প্রবণতা ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং ডি-ডলারাইজেশন সফল হলে তা মার্কিন অর্থনীতির জন্য গুরুতর পরিণতি হতে পারে।

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ, এসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার এবং ম্যানেজার, বিডিবিএল, কারওয়ান বাজার শাখা।

টিবি