images

মতামত

ব‌ইমেলায় কাবুলিওয়ালা, আগামীর জন্য সাবধান

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০৫ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৯ পিএম

বাঙালির প্রাণের উৎসব একুশের বইমেলা। লেখক-পাঠকের মিলনমেলা এই বইমেলা। বই বেচাকানোর জন্য এখন অনলাইন প্লাটফর্ম রয়েছে। অনেকেই তার প্রয়োজনীয় বইটি অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকেই কিনে নিতে পারেন। ৬/৭ বছর আগে থেকেই এ প্লাটফর্মটি একটু একটু করে গড়ে উঠছে। সর্বশেষ করোনার ছোঁয়াছুঁয়ির যে শুচিবাই, তাতে অনলাইন বেচাকেনা একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

কিন্তু বইমেলা থেকে বই সংগ্রহ এবং লেখকের সঙ্গে এক বাউন্ডারিতে উষ্ণতা ও নিঃশ্বাস ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনুভবই আলাদা। আর অনলাইন বইয়ের দোকান থেকে যারা বই কেনেন তারাও বইমেলায় প্রিয় লেখকের হাত থেকে বই নিতে ছুটে আসেন মেলা প্রাঙ্গণে।

দিনে দিনে মেলায় আসার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে গত দু বছর করোনাভাইরাসের কারণে মেলা উন্মুক্ত না থাকায় বই প্রিয় মানুষদের মধ্যে এক ধরনের হাঁসফাঁস তৈরি হয়েছে। আবার অনলাইনের কারণে অনেকে মনে করেছেন হয়তোবা মেলায় ভিড় এবার কম হবে। কিন্তু এবার প্রথম দিন থেকেই মেলায় উপচেপড়া ভিড়।

যদিও প্রকাশক ও লেখকরা বলেছেন, মানুষের ভিড়ে তারা যতটা প্রত্যাশী হয়েছেন ততটাই হতাশ হয়েছেন মেলায় আসা উৎসুক মানুষদের আচরণ দেখে। কারণ মেলায় নতুন করে ইউটিউবার, ফেসবুক লাইভ এবং টিকটকাদের হিড়িক ছিল একটু বেশি। আর যেহেতু এখন টেলিভিশনের সংখ্যাও বেশি, আবার সাথে ডিজিটাল প্লাটফর্ম এবং মোজো (মোবাইল সাংবাদিকতা)। এছাড়া ব্যক্তিগত মোবাইল একটি ক্যামেরা ও ইউটিউব হয়ে ওঠে এখন। তো, সব মিলিয়ে মেলার প্রাঙ্গণটা ছিল এবার স্টুডিও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশক-লেখকরা মেলায় আগতদের নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা করেছেন। বিষয়টি আমাদের চোখ এড়ায়নি। হামেশাই ফেব্রুয়ারির মেলার এক মাস বই না কিনে টিকটক ও ইউটিউব করা এবং সেলফি তোলা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

এই এত উপদ্রবের পরেও বইপ্রেমীরা কিন্তু মেলায় ঠিকই গিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বই কেনার জন্য একটা বাজেট করে তারা। আর এটা পৃথিবীজুড়েই জানা কথা, বই পাগল মানুষদের সত্যিকার অর্থেই কাড়ি কাড়ি টাকা থাকে না। জ্ঞান চর্চা ও বই পড়া কোনো না কোনোভাবেই যেন মধ্যবিত্তের একটা সম্পদ। এর ব্যতিক্রম অনেক আছে। আর তাছাড়া বই পড়তে অর্থ-বিত্ত থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও এটা বলতে শোনা যায়।

যাই হোক, অনেকটাই লেখালেখির লোক হওয়ার কারণে এবং লেখকদের প্রতি একটা প্রবল প্রেম আর ভালোবাসায় চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। একটা লজ্জাও অনুভব হলো। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটায় মেলায় ঢুকেছি। অনেক পুরনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে এবং লেখকদের সঙ্গে কিছুটা মতবিনিময় হবে এটাই প্রত্যাশা ছিল। ঘটলো তাই। কিন্তু বাধ সাধলো অন্যকিছু।

বরাবরের মতো নিজেদের বন্ধুবান্ধব এবং যাদের সঙ্গে এক সময় মেলায় আড্ডা দিতে দিতে দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাটা মধ্যরাতের দিকে যেত, তাদেরকে তো মেলায় আসতেই বলি। বিকেল চারটা বেজে গেল, কয়েকজন বলল এসেছি।

এক বন্ধুকে বললাম, আমি অমুক স্টলের পাশের স্টলে আছি চলে এসো। স্টল নাম্বার বললাম।

সে বলল, ‘বন্ধু ওদিকে যাব না, আমার একটু সমস্যা আছে।’

বললাম, ‘তুমি কোথায় আছো আমি আসি।’

তার লোকেশন অনুযায়ী আমি গেলাম। আমি সেখানে গিয়ে আরো দুই বন্ধুকে ফোন দিয়ে বললাম ওদের এখানে আসতে বলেছি।

একজনের নাম শুনে আমার বন্ধু ক্ষেপে গেল।

‘আমি চলে গেলাম, আমার সময় নেই।’

আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি সমস্যা তোমার।’

খুব চাপাচাপি করার পর বলল, ‘আমি আর বই মেলায় আসব না। এখানে সব কাবুলিওয়ালারা আসে।’

আমি একটু অবাক হলাম। ওর কথার মানে কি জিজ্ঞেস করলাম।

‘দেখো বইমেলায় আসলেই এক বিপদে পড়তে হয়। তুমি যাকে এখানে আসতে বলেছ, আমাদের সেই বন্ধু বারোখানা বইয়ের মালিক। যখনই মেলায় আসি দেখা হয়ে গেলেই, তার বই কিনতে বলে। সৌজন্যতার খাতিরে কিনতেও হয়। আমি তো আসলে কিছু প্ল্যান করে মেলায় আসি। কি বই কিনব সেটার একটা তালিকা ও থাকে।’

অন্যের অনুরোধেরগুলো কিনতে কিনতে আমার পছন্দের বা প্রয়োজনীয় বইগুলো আর কেনা হয় না। বইমেলায় লেখকরা ব্যাগের মধ্যে করে বই নিয়ে ঘুরেন। আর দেখা হলেই নিজের বইয়ের প্রশংসা করতে থাকে এবং কেউ কেউ আছেন জোর করে বই গছিয়ে দেন। তারপর কায়দা করে বলেন, আপনার মূল্যবান মন্তব্য খুব জানা দরকার। বইটা পড়ে জানাবেন কেমন লিখলাম।

এভাবেই রাগ ঝাড়ছে আমার বন্ধু। এরপর আমি আরো ৪-৫ দিন মেলায় গিয়েছি। অনেককে দেখেছি কাবুলিওয়ালা লেখকদের ভয়ে কোন কোন স্টলের সামনে দিয়ে তাদের পরিচিতজনরা যাচ্ছেন না। অনেককেই বলতে শুনেছি, এই এখান দিয়ে যাবেন না, আছে কিন্তু বই ধরিয়ে দেবে।

বইমেলায় এই উৎপাতে এবার অন্য যেকোনো বারের চেয়ে বেশি। হ্যাঁ, নিজের বইয়ের প্রশংসা হতেই পারে, আবার বন্ধু কাছের মানুষের কাছে প্রত্যাশা থাকবেই। কিন্তু সেটা পীড়াপীড়ির পর্যায়ে গেলে মাথা হেট হয়ে আসে।

সেই ফেরিওয়ালার মত ‘বই নিবেন গো বই’ কায়দায় লেখক যদি নেমে যায় তাহলে আমরা কোথায় যাব?-এই মন্তব্যটি আমার নয়। মেলায় আগত এক পাঠকের।

একজন পাঠক বলতে থাকলেন আমাকে উদ্দেশ্য করে, ‘এই সাংবাদিক শোনেন (তিনি আমার পূর্ব পরিচিত), এই অখ্যাত কুখ্যাত লেখকরা ব্যাগে ভরে ভরে যে বই ফেরি করছে আপনারা দেখেন না। আর পরিচিতজনদের পেলেই বই কেনার জন্য চাপাচাপি করছে।’

আমার চেনা-জানা এবং পাঠক কাটতি আছে এমন কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা কয়েকজন বললেন, ‘আমার একটি বই প্রকাশ হয়েছে, এটাতো নিজের পরিচিতদের কাছে বলাই যায়। কিন্তু বই কেনার জন্য তো চাপাচাপি করা যায় না।’

একজন বললেন, একটা বাজেট নিয়ে মেলায় ঢোকেন কেউ কেউ। সেটা অনুরোধে থেকে গিলতেই যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে প্রয়োজনীয় বইটা বা তার পছন্দের বইটা কিভাবে কিনবেন তিনি? এতে লেখকরা খাটো হয়ে যায়। ভালো বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়।

বইয়ের প্রচার-প্রচারণা করতে তো সমস্যা নেই, কিন্তু ক্রেতার স্বাধীনতা তো দিতে হবে। বাজারের অন্য কোন পণ্যের সঙ্গেই বই এর তুলনা হয়না। ঈদ মার্কেট এর মত বাইচ্ছালন, দেইখ্যা লন- এটা তো মেলায় করা যাবে না।

লেখক-কবিদের পাঠকদের সঙ্গে জেরা করতে দেখে আমি অবাক হয়েছি। ৭০ কিংবা ৮০টিরও বেশি বইয়ের এক লেখক গতবারের বইমেলায় এক পাঠকের সঙ্গে ভীষণ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেছেন। কারণ তিনি যে এতগুলি বই লিখেছেন ওই পাঠক একটি বইও পড়েননি। সেই লেখক এমনই ক্ষেপে গেলেন, এক পর্যায়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন না? আমার একটি বইও পড়েন নি? আরে মিয়া তার মানে আপনি কোন পড়ালেখায‌ই করেন না।’

সেই পার্থক্য এক কাঠি সরেস, ‘আপনার বইগুলো এক কপি করে দিন। আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনার মত একজন লেখক কে আমার জানা উচিত এবং চেনা উচিত।’

তো সেই লেখক যে প্রকাশনী থেকে বই বেরিয়েছে সেই স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খুবই আনন্দিত।

‘এই আমার সবগুলি বই এক কপি করে নাও।’

ওই স্টলে মানে ওই প্রকাশনী থেকে লেখক এর ১২ কি ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো বান্ডেল করা হলো।

এবার লেখক বললেন চলেন একটু সামনে আরেকটা প্রকাশনী থেকে আমার আটটি বই বেরিয়েছে। এরকম তিন-চারটি প্রকাশনীর কথা বললেন।

আর পাঠক বললেন, ‘আমি এখানেই দাঁড়িয়েছি আপনি বইগুলি নিয়ে আসেন।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সবকটি স্টল ঘেঁটে লেখক ৫০টির বেশি ব‌ই আনলেন। সঙ্গে ক্যাশ মেমো। লেখকের মুখে হাসি। সেই পাঠককে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘আপনি আসলে বই পোকা। এরপরে আপনাকে নিয়ে লিখব।’

পাঠক‌ও খুশিতে গদগদ, ‘তাতো লিখতেই হবে। আপনি হলেন জাত লেখক। সক্রেটিস কে হার মানিয়ে দেবেন। তিনি অলসতার কারণে লিখতে পারেননি। তার শোধ আপনাকেই নিতে হবে। আমি খুবই আনন্দিত, আজ ঘরে বই উৎসব হবে।’

বই প্যাকেট হলো। লেখক মহাশয় ক্যাশ মেমো এবং বইয়ের বান্ডেল গুলো এগিয়ে ধরলেন পাঠকের কাছে।

পাঠক বললেন, ‘ভাই বইগুলি তো আমাকে টিএসসি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হবে। আমার পক্ষে তো এত বই নিয়ে এই গাড়ি পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব না। এই বলে খুবই ছোট একটা প্যাকেট তিনি হাতে নিলেন।’

আচ্ছা আচ্ছা বলে লেখক দুই হাতে দুটি বড় বান্ডেল এবং স্টলে থাকা দুজনকে আরো দুটি বান্ডেল দিলেন।

মনে করিয়ে দিলেন ক্যাশ মেমোর কথা। মানে বইগুলোর দাম পরিশোধের বিষয়টি ইঙ্গিত করলেন।

পাঠক এমন ইঙ্গিত করলেন মনে হলো টিএসসির ওখানে গিয়েই পেমেন্টটা দিবেন।

লেখক চললেন পাঠকের পিছে পিছে। কৌতূহলবশত আমরা কয়েকজন ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।

২০ মিনিট পারলে লেখক ফিরে আসলেন। এই পাঠক আমাদের এক বন্ধুর বন্ধু। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আমরা দেখছিলাম। আমাদের বন্ধুর কাছে পাঠকের ফোন নাম্বার আছে।

যাই হোক, লেখক ফিরে এলেন। ভীষণ ক্ষিপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে স্টলের দুই সেলসম্যান। তারাও আসলো। লেখক বলছে, মেলায় বই কিনতে এসেও চালাকি। দুইদিন পরে টাকা দিয়ে যাবে বলল। রাগে গজগজ করছে লেখক।

‘টাকা নেই তো এতগুলি বই নেয়ার কি দরকার’- পরিচিত হলে এরকমই হয়। আলতু ফালতু কাজে টাকা নষ্ট করবে আর বই কেনার ক্ষেত্রে তখন পকেট ফাঁকা।

আমাদের বন্ধু, তিন মহালেখকের যেখান থেকে বই বেরিয়েছে সে প্রকাশনী থেকে তারও বই বেরিয়েছে। তাই বিষয়টি কাছ থেকে দেখা।

কৌতুহলী বন্ধু ফোন দিলেন সে পাঠকের কাছে। ‘এতগুলি বই নিলা টাকা দিলে না? এটা কেমন কথা।’

ওপার থেকে পাঠক উত্তর দিলেন, ‘ওই ব‌ইগুলো যে বহন করে এনেছি, এটাই বড় ব্যাপার। এরকম হেঁটে হেটে বই বিক্রি করার শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই শাস্তিটা দিলাম। আর কাউকে আগ বাড়িয়ে বই বিক্রি করবে না।’

এবারের বইমেলায় এরকম জোর করে বই গছিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা দেখেছি, তাতে সত্যিকার পাঠক বইমেলা বিমুখ হয়ে যেতে পারে। তবে এটা বলতে পারি, লোক সমাগম কমবে না। অনুরোধ, লেখকদের কাবুলিওয়ালার মতো দেখতে চাই না। বই তো বিক্রি করা এবং নিজের ঢোল পেটানোতে অসুবিধা নাই। তবে সেই ঢোলের কাঠি পাঠককে যেন আঘাত না করে। লেখক-সাহিত্যিক, কবিরা আমাদের সামনে মাথা উঁচু করেই থাকেন।

লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, দেশ রূপান্তর

/জেএম