images

মতামত

ধর্মদর্শন: মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১০ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:৩৬ পিএম

আজ ১০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। সকল মানুষের মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালিত হয়। মানবাধিকার শব্দটি ‘মানুষ’ ও ‘অধিকার’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ মানবাধিকার হলো মানুষের অধিকার। মানুষ চায় মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং পূর্ণ অধিকার নিয়ে বাঁচতে। মানুষের অধিকার জন্মগত। সৃজনশীল বিকাশ ও সন্তোষজনক জীবনযাপনে প্রযোজনীয় অধিকারের সমন্বিক রূপ হচ্ছে মানবাধিকার। ‘অধিকার’ হলো ব্যক্তির ন্যায্য পাওনা। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় মানুষের ন্যায্য পাওনা বা স্বার্থ আইন দ্বারা স্বীকৃত। কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রসমূহ নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় প্রণয়ন করে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি, বিধি ও আইন। বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত নাগরিকগণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও বিদ্রোহ করে যাচ্ছে। যার রূপ দেশ বা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। বেঁচে থাকা, মাতৃভূমির অখন্ডতা রক্ষা,গণহত্যা, জাতিগত নিধন, শ্রমমূল্য নির্ধারণ, গণতান্ত্রিক চর্চা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিশ্বায়নের প্রভাবসহ বিবিধ কারণে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।

মানুষ কেন পরের মঙ্গল সাধনে ব্রতী হবে? অপরের কল্যাণে ব্যক্তির কি স্বার্থ! এসব প্রশ্নের উত্তর ধর্মচর্চার প্রসঙ্গ সংশ্লিষ্ট। মানুষ ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির প্রত্যাশায় ধর্মচর্চা কওে এবং অপরের মঙ্গল সাধন করে। মানব সমাজের একটি আদি ও প্রাচীন প্রতিষ্ঠান ধর্ম। ধর্ম মানব সমাজে মানবাধিকার মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করে। ধর্মতত্ত্বের সাথে মানবাধিকার তত্ত্বের যোগসূত্র আছে। ধর্মতত্ত্ব এমন এক ধরণের আইনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে যা রাষ্ট্রীয় আইনের ছেয়ে অধিক কার্যকর। ধর্ম সমাজ বা রাষ্ট্রকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিতকরণের শক্তিশালী মাধ্যম। সমাজ নিয়ন্ত্রণের সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র ধর্ম। ধর্মদর্শনই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য শক্তি।

বিশ্ববাসী বিগত শতাব্দীতে দু’টি ভয়াবহ যুদ্ধ মোকাবেলা করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯১৯ সালে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিয়ে ভার্সাই চুক্তির আলোকে বিশ্ববাসী ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ গঠিন করে। এ জাতিপূঞ্জ ২য় বিশ্বযুদ্ধ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়। বিশ্ব শান্তি রক্ষা ও যুদ্ধ প্রতিহত করার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর বিশ্বের ৫০টি রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ গঠন করে। এ প্রেক্ষিতে সানফ্রানসিস্কো নগরীতে ১১১ ধারা সম্বলিত জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়। এ সনদের মূল লক্ষ্য হলো: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

জাতিসংঘ সনদের ১নং ধারায়- মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশা নিরসন, মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে মানবাধিকার কমিশনের প্রথম সভায় আন্তর্জাতিক বিলের খসড়া প্রণয়নের জন্য ৯টি সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভানেত্রী নির্বাচিত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিস ইলিনর রুজভেল্ট। কমিটি দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২১৭ নং রেজ্যুলেশন হিসেবে ‘মানবাধিকার সর্বজননীন ঘোষণা পত্র’ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সর্বজনীন ঘোষণা পত্র বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে ১৯৫০ সাল হতে ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও’।

মানবাধিকার মানুষের জন্মগত এবং জীবনে অবিচ্ছেদ্য। মানবাধিকারের উপাদান দু’টি। প্রথমত জন্মগত: যা নতুনভাবে অর্জন করা যায় না। দ্বিতীয়ত অভিচ্ছেদ্য: এটা কেড়ে নেওয়া যায় না। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একজন ব্যক্তি বিভিন্ন অধিকার ভোগ করবে। যথা: সমমর্যাদা, জীবন ধারণের অধিকার, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, দাসত্বে না থাকা, নির্যাতিত না হওয়া, আইনের দৃষ্টিতে সমান, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, স্বাধীনভাবে চলা, সামাজিক নিরাপত্তা, মতপ্রকাশ, চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক আশ্রয়, ধর্মের স্বাধীনতা ইত্যাদি। মানবাধিকার মানুষকে সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিময় জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। বৃহত্তর পরিসরে একটি রাষ্ট্র মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা চালয় উপযোগী আইন, বিধি প্রণয়ন ও সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে। কিন্তু মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষুদ্র পরিসরে মানবাধিকার চর্চা অতি জরুরি। যেমন- পরিবার বা সমাজিক বলয়ে মানুষের প্রতি পারস্পরিক সম্মন প্রদর্শন, মর্যাদা, কল্যাণ ও সম্প্রীতি বিধানের জন্য মানবীয় মূল্যবোধ অপরিহার্য্য। এতে সর্বস্তরে মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে দেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ১৮টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের অনু:২৭-আইনের দৃষ্টিতে সমান, অনু:২৮-ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য প্রদর্শন না করা অনু:২৮ সরকারী চাকুরী লাভে সমান সুযোগ, অনু:৩৪-সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ, অনু:৩৭-সভা সমাবেশের স্বাধীনতা, অনু:৩৯-চিন্তা, বিবেক ও বাক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদসমূহের আলোকে সরকার নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী আইন ও বিধি প্রণয়ন করছে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

বর্তমান সরকার একটি আদর্শ কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সামাজিক ন্যায়বিচার হচ্ছে সম্পদের সুষম বন্টন সুনিশ্চিত করা। সামাজিক ন্যায়বিচার রাষ্ট্রের একটি আদর্শিক ব্যবস্থা। যেখানে সমাজের সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এ ব্যবস্থায় সমাজের বঞ্চিত, নিঃস্ব, প্রতিবন্ধী ও সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠী তথা: বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধাব, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত, হরিজন, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

মানবাধিকার, সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র বিবিধ আইন প্রণয়ন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় গৃহীত উদ্যোগসমূহের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সকল পক্ষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন ব্যক্তিকে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় তাড়িত করে। সমাজের অনগ্রসর, বঞ্চিত, সংখ্যালঘু, সুবিধাবঞ্চিত ও বিপন্ন মানষের সেবায় এ গিয়ে আসতে হবে সকলকে। তাছাড়া ধর্মচর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আয়বৈষম্য হ্রাস, ভোটাধিকার, দারিদ্র বিমোচনসহ সর্বক্ষেত্রে সমাজের সকল মানুষ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা হোক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম