ঢাকা মেইল ডেস্ক
১২ নভেম্বর ২০২২, ০৬:২৬ পিএম
আধুনিক নগর জীবনে কত ব্যস্ত মানুষ, কত বিচিত্র তার প্রকাশ! প্রতিটা রাতের শেষে সূর্য ওঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেকটি কর্মমুখর দিন। শুরু হয় নিরন্তর ছুটে চলা। তারই মাঝে একটু অবসর। একটু অবকাশ নেওয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ নিয়েই মানুষের জীবন।
মশাবাহিত একপ্রকার ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু। এই জ্বর অন্যান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর থেকে আলাদা। এই জ্বর কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়। এই ভাইরাস জ্বর এককভাবে অথবা অন্যান্য ভাইরাস (চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, বার্মা ফরেস্ট, ফ্লু, রেসপাইরেটরি সিনসাইটিয়াল) ও ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গেও হতে পারে।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে সারাদেশে মারা যায় ১৬৪ জন লোক। সেই থেকে চলছে এডিশ মশার আক্রমণ। ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব চলা অবস্থায় এই জীবন চলার মাঝেই ২০২০ সালে সারা বিশ্বে হানা দেয় করোনা। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল পুরোটাই ছিল করোনাভাইরাস মহামারির দুই বছর। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস। বর্তমানে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে।
বর্তমানে চলছে ডেঙ্গু জ্বরের মহামারি। সারাদেশে বেড়েছে এর প্রকোপ। করোনাভাইরাস যদি নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণে আসবে না। কী করছে সিটি করপোরেশন। তাদের দায়-দায়িত্বই বা কী? ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারই বা কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে দেশে রেকর্ড পরিমাণ মৃত্যু। ২০১৯ সালে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল ডেঙ্গু। সেবার সারাদেশে মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭। বর্তমানে দেশের হাসপাতালগুলোয় ভর্তি আছেন প্রায় পাঁচ হাজার রোগী। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার আক্রমণে এর বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় কার? বিপুল অর্থ খরচের পরও কেনইবা কর্তৃপক্ষ এডিস মশার কাছে পরাজয় বরণ করছে; তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন দেশবাসীর। রাজধানী ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফল ভোগ করছে পুরো দেশবাসী। কেননা, ঢাকা থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। চলতি বছর আজ পর্যন্ত (১২ নভেম্বর) ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৯৯ জন। এরপরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের একটিও ডেঙ্গু বিস্তারের দায় নিচ্ছে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, যারা এডিস মশার প্রজনন রুখতে ব্যর্থ, তারা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী। ঢাকা ও সারাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর জন্য তাদের দায় নিতে হবে। কেননা সবকিছু জানা ও বোঝার পরও তারা বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। এজন্যই ডেঙ্গুর প্রজনন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বর্তমানে ঢাকায় মশার প্রজনন বৃদ্ধি বা কমার সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের খামখেয়ালিপনা এবং কর্তব্যে অবহেলাই দায়ী। কোনোভাবেই তারা তাদের এই ব্যর্থতা এড়িয়ে যেতে পারেন না।
এডিশ মশার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢেলে সাজানো না হলে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ ঘটানো সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২০১৮ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৬ জন। এর আগে ২০০০ সালে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৪০। ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নয়জন এবং ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২৮ জনের মৃত্যু হয়। এ বছরের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া জুনে ১, জুলাইয়ে ৯, আগস্টে ১১ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে-এ ব্যাপারে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সেটা পুরোপুরি মিলে গেল। আগে থেকে জানানোর পরও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে এখন নগরবাসী জীবন দিয়ে তার খেসারত দিচ্ছে।
২০১৯ সালে মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন লক্ষ করা যায়নি। কার্যকর সুফল পেতে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। যেনতেনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমবে না। পাশাপাশি নগরবাসীকেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক হতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে কাজ করতে হবে। এডিস মশা বা মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সিটি করপোরেশন করতে চায় কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সিটি করপোরেশন যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, এতে নগরবাসীর কোনো সুফল মিলছে না।
সিটি করপোরেশনকে এখান থেকে বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি হবে না। বর্তমান মশার উপদ্রব বৃদ্ধি বা কমার বিষয়টি প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে মাঝে মাঝে এডিসের প্রজনন বাড়ছে এবং মাঝে মাঝে কমছে। মশার উপদ্রবের কারণে খালি জায়গায় বসার জো নেই। খালি জায়গায় বসলেই চারপাশে বোল্লার চাকের মতো মশা এসে শরীরে বসে।
ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সময়টা ডেঙ্গুর প্রজননের প্রবণতা বাড়ে। আর এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে, মৌসুমের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে অবহিত করা হয়েছিল। যা আমরা পত্রপত্রিকা পড়ে জানতে পারি। এরপরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যকর তৎপরতার কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বছরব্যাপী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার, সিটি করপোরেশনগুলো সেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও কর্তাব্যক্তিরা এসব নিয়ে কোনো মাথা নাড়েন না। যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়, তখন নড়েচড়ে বসেন। মানুষের মন ভোলানোর জন্য দৃশ্যমান কিছু কাজ করছেন, যেটা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না।
পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. জোবায়দুর রহমান বলেছেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক অবস্থার দায় কোনোভাবেই সিটি করপোরেশনের নয়। দেশের জনগণ তার কথায় একমত। তাহলে এই দায় কার?
ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশ হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষার করাতে ১০০ টাকা ফি দিতে হবে। আর বেসরকারি হাসপাতালে দিতে হবে ৩০০ টাকা। সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ‘কমিউনিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে পর্যালোচনা’ শীর্ষক সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
করোনাভাইরাসের সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফিও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন সরকার। কিন্তু সেটা কোনো কাজেই আসেনি। সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি টাকা আদায় করেছে হাসপাতালগুলো। ডেঙ্গুর বেলাতেও কি একই অবস্থা হবে।
২০১৯ সালে সারাদেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা বিনামূল্যে করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী বিনামূল্যে নয়, সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে হলে ১০০ টাকা লাগবে এবং বেসরকারি হাসপাতালে লাগবে ৩০০ টাকা।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদের পরিষ্কার রাখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতায় সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দিকে না তাকিয়ে পাড়া-মহল্লায় তরুণেরা দল বেঁধে নিজেরাই নেমে পড়তে হবে আমাদের নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে। সরকার মশা মারবে, টিকা আনবে, হাসপাতাল বানাবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। করোনাভাইরাস যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুখ-নাক ঢেকে রাখতে হবে। সেই রকম এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে।
প্রাণ বাঁচানো ফরজ। তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে। করোনা বা ডেঙ্গু উৎসব চেনে না। সাবধান না হলে আমরা যে কেউ যখন তখন আক্রান্ত হতে পারি। ডেঙ্গুর সতর্কতাগুলো আমাদের অজানা নয়। কোনোভাবেই যেন মশা আপনার নাগাল না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে দরিদ্ররা তো রয়েছেই। রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব। সরকারকে সবকিছুই বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের কথা ভেবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট